ছিমছাম একটি স্টোররোম। লকার-সহ আরও বেশ বাক্স বোঝাই কিছু জিনিস সার দিয়ে রাখা রয়েছে লোহার তাকে। হঠাৎ এমনই চারটে বাক্স সরিয়ে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক। বোঝা গেল, এই বাক্সগুলির পিছনে আয়তনে বড়ো আরও একটি পিচবোর্ডের বাক্সের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। হ্যাঁ, ‘ইনসাইড ম্যান’ সিনেমাটার কথাই হচ্ছে। ব্যাঙ্ক ডাকাতির পর ব্যাঙ্কের ভিতরেই এক সপ্তাহ এভাবে লুকিয়ে ছিলেন রাসেল। সঙ্গে ছিল ব্যাগ বোঝাই সোনা-দানা। বিপদের আশঙ্কা সরে গেলে বাক্স থেকে বেরিয়ে পলাতক হন তিনি। কিন্তু বাস্তবে ছোট্ট একটি বাক্সের (Box) মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখা আদৌ কি এমনটা সম্ভব?
অবিশ্বাস্য মনে হলেও সম্ভব। অন্তত ইতিহাস সেই কথাই বলছে। আজ থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগের ঘটনা সেটা। অকুস্থল উত্তর-পূর্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তখনও পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহাল তবিয়াতেই চলছে ক্রীতদাস প্রথা। আর এই বর্বর প্রথার শিকার মূলত কৃষ্ণাঙ্গরাই। এই দাসত্ব, অত্যাচার থেকে বাঁচতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পলাতক হয়েছিলেন ক্রীতদাস হেনরি ব্রাউন (Henry Brown)।
১৮১৫ কিংবা ১৮১৬ সালে হেনরির জন্ম ভার্জিনিয়ার হার্মিটেজে। বাবা-মা ছিলেন ক্রীতদাস। কিন্তু তাঁদের স্মৃতি তাঁর কাছে ছিল অত্যন্ত ঝাপসা। অল্প বয়সেই বাবাকে প্রাণ দিতে দেখেছিলেন তিনি। মায়ের সঙ্গেও ‘বিচ্ছেদ’ হয় মাত্র ১৫ বছর বয়সে। ওই অল্প বয়সেই তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল তামাকের কারখানায় কাজ করার জন্য। সেখানে গিয়ে আবার মালিকবদল। তবে ভাগ্যের জোরেই এমন এক মালিক পেয়েছিলেন, যিনি আদতেই সুহৃদয় ব্যক্তি। বাকিদের থেকে একটু অন্যরকম। অত্যাচারের ধার ধারেন না তিনি। বরং, ক্রীতদাসদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলাই বেশি পছন্দ তাঁর। হেনরির ভাষায় তিনি ছিলেন ‘আনকমনলি কাইন্ড’।
মালিকের এই নমনীয় চরিত্রই যেন শাপে বর হয়ে দাঁড়াল তাঁর কাছে। ধীরে ধীরে ক্রীতদাস সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠলেন হেনরি। সরব হলেন তাঁদের অধিকার নিয়ে। এত কিছুর পরেও কোনো সমস্যা করেননি তাঁর মালিক। তবে গোলযোগ বাঁধল অন্য জায়গায়। রীতিমতো ঘুম ছুটে গেল মার্কিন প্রশাসনের। তাঁর বক্তৃতায় নতুন সাহস পেলেন অত্যাচারিত ক্রীতদাসরা। ঘটতে থাকল একের পর এক পলায়নের ঘটনা। আর সেই সূত্রেই ফরমান জারি হল হেনরির বিরুদ্ধে। ‘ফিউজিটিভ স্লেভ ল’, ১৮৫০’ অনুযায়ী তাঁকে চরমতম শাস্তি দেওয়ার কথাও ঘোষণা করল যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন। এবার যে তাঁর মালিকেরও সাধ্য নেই তাঁকে বাঁচানোর। তবে?
আরও পড়ুন
স্বমহিমায় চলছে দাসপ্রথা, এখনও মধ্যযুগীয় অন্ধকারে ডুবে আফ্রিকার এই দেশ
প্রাণে বাঁচতে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে পালাতে হবে তা ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন হেনরি ব্রাউন। ঠিক সেটাই করলেন তিনি। মালিকের তামাকের ব্যবসা ছিলই। তিনি শুধু পালানোর জন্য ব্যবহার করলেন সেটাকে। ঠিক হল, ২ ফুট উচ্চতার তিন ফুট বাই আড়াই ফুট বাক্সের মধ্যেই লুকিয়ে ব্রিটেনে পালাবেন তিনি। সাহায্য করলেন আরেক সম্ভ্রান্ত কোয়েকার ব্যবসায়ী পাসমোর উইলিয়ামসন এবং ভিজেল্যান্স কমিটি।
আরও পড়ুন
পঞ্চাশ বছরের দাসত্ব শেষ, সুস্থ জীবন ফিরে পেল আগ্রার 'ফুলকলি'
১৮৫০ সালে সেই বাক্সবন্দি হয়েই জাহাজে চেপে পাড়ি দেওয়া ইংল্যান্ডে। সেখানে গিয়ে নতুন জীবন। পথে পথে ম্যাজিক দেখানো শুরু করলেন হেনরি। অল্পদিনের মধ্যেই বেশ জনপ্রিয় স্ট্রিট শোম্যান হয়ে ওঠেন তিনি। তারপর বিবাহ করেন এক ব্রিটিশ ভদ্রমহিলাকে। তবে ক্রীতদাসেদের অধিকার আন্দোলন চলছিল এই সমান্তরালভাবেই। বিদেশের মাটিতেও তিনি সরব হয়েছিলেন তাঁর মতো অসংখ্য মানুষের ‘স্বাধীনতা’-র জন্য।
আরও পড়ুন
দেড়শো বছর আগেও আমেরিকায় দাসপ্রথা চলত রমরমিয়ে
১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতি পড়ে দাসত্ব প্রথায়। নেপথ্যে ছিলেন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের পরিকাঠামোও বদলাতে থাকে ধীরে ধীরে। এরও প্রায় ১০ বছর পর ১৮৭৫ সালে দেশে ফিরে আসেন হেনরি। বাকি জীবনটা কেটে ছিলেন বক্তা ও শোম্যান হিসাবেই। কৃষ্ণাঙ্গদের নতুন জীবন খুঁজে পাওয়ার চাবিকাঠির ব্যাপারে নানারকম অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা দিতেন হেনরি। ১৮৯৭ সালে টরোন্টোতেই মারা যান এই কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু ওই বাক্সবন্দি হয়ে পালানোর ঘটনার প্রমাণ? মার্কিন প্রশাসনের বিভিন্ন নথি এবং হেনরির লেখা আত্মজীবনী ‘ন্যারেটিভ অফ লাইফ অফ হেনরি বক্স ব্রাউন’ থেকেই সেই রুদ্ধশ্বাস অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়। অতটুকু বাক্সের মধ্যে কয়েকদিন আঁটোসাঁটো হয়ে বসে থাকার কথা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয় রীতিমতো। তবে অত্যাচার সহ্য করতে করতে মানুষ বোধ হয় ঠিক এতটাই মরিয়া হয়ে ওঠে নতুন জীবনের জন্য…
Powered by Froala Editor