“কোনোকিছুই আমরা খুব সহজে পাইনি। যা পেয়েছি, লড়াই করে পেতে হয়েছে।” বলছিলেন শিক্ষক সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়। আসলে কিছুদিন আগেই নির্বাচন কমিশন চলতি নির্বাচনে সার্বিক অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই বলা হয়েছে ব্রেইল ইলেকশন স্লিপ, পিক আপ অ্যান্ড ড্রপ এমনকি ঘরে বসে পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী প্রক্রিয়া তো একদিনের একটা ভোট দেওয়া নয় শুধু। সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় কি এখনও সমান সুযোগ পাচ্ছেন দৃষ্টিহীন নাগরিকরা? সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, “২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়েই প্রথম ব্রেইল ইলেকশন স্লিপের ব্যবহার শুরু হয়। সেবছর নরেন্দ্রপুর ব্লাইন্ড বয়েজ অ্যাকাডেমি থেকে সমস্ত স্লিপ ছাপানো হয়েছিল।”
“তবে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার বিষয়টি সংবিধানে যত সহজে নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে তার প্রতিফলন কিন্তু এখনও যথেষ্ট কম। আমরা প্রতি মুহূর্তে সেই প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলেছি।” সায়ন্তনদার এই কথার সূত্র ধরেই প্রশ্ন ওঠে, কেন স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে দৃষ্টিহীনদের ভোটদানের অসুবিধা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে? আসলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার একদিনের ভোটদানের মধ্যে সীমাবদ্ধও থাকে না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিহীন গবেষক শ্রেয়া ঘোষের কথায়, “আমাদের সবসময়ের চলাফেরার রাস্তা যদি নিরাপদ না থাকে, আমার প্রতিবন্ধকতা নিয়েও স্বাবলম্বী হওয়ার উপযুক্ত সুযোগ যদি না থাকে, তাহলে এই গণতান্ত্রিক অধিকারের কোনো অর্থই নেই।” সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “প্রতি বছর নির্বাচনের আগে সমস্ত রাজনৈতিক দল একঝাঁক প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হয়। এমনকি আরপিডব্লিউডি আইনকেও সেই প্রতিশ্রুতির মতোই মনে হয়। ২০১৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আরপিডব্লিউডি আইন প্রয়োগ করা হয়, তাও আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল হিসাবে। বাকি রাজ্যে এখনও সেই আইনের কোনো প্রয়োগ নেই।”
এমনকি নির্বাচনী প্রচারের একটা বড়ো অংশ জুড়েও ব্রাত্য থেকে যান দৃষ্টিহীন ভোটাররা। আজও এদেশে নির্বাচনী প্রচারের সবচেয়ে বড়ো মাধ্যম দেয়াললিখন এবং পোস্টার। কিন্তু এই দুই মাধ্যমের একটিও তাঁদের কাছে পৌঁছয় না। সায়ন্তনবাবু জানালেন, “২০১৯ সালের নির্বাচনে বাংলার একটি রাজনৈতিক দল আমাদের জন্য তাঁদের অডিও ইশতেহার প্রকাশ করেছিলেন। এবছর তাঁরাও ভুলে গিয়েছেন।” সংসদীয় ব্যবস্থায় মানুষের গণতন্ত্র পালন হয় প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমেই। অথচ যে প্রতিনিধিকে তিনি সরকার গঠনের দায়িত্ব দিচ্ছেন, তিনি তাঁর দাবির পক্ষে লড়বেন কিনা, জানেন না দৃষ্টিহীন ভোটারদের একটা বড়ো অংশই। যেন এই বিষয়ে তাঁদের অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়া অত্যন্ত সহজ একটি বিষয়। শ্রেয়া ঘোষের কথায়, “আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে এ-বছর বাড়িতে বসে পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেখানেই আবারও আমাকে ভোট দিতে অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হবে।” সত্যিই কি প্রত্যেকের গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করা আজ এত বছর পরেও এতটাই কঠিন?
“আমি চাই না দৃষ্টিহীন হওয়ার সুবাদে আমি সবার আগে ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসব। কোনো প্রয়োজন নেই। আমি শুধু চাই, বাকি নাগরিকদের মতোই আমরাও যেন সমানভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারি।” একইসঙ্গে সায়ন্তনবাবু বলছিলেন, “আর দৃষ্টিহীনদের কথা ভাবতে গেলে কিন্তু সবার আগে মাথায় রাখতে হবে, দেশের ৭০ শতাংশ দৃষ্টিহীন মানুষ থাকেন গ্রামে। আমাদের এমন ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে, যা বাস্তবেই প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। অ্যাক্সেসেবল ইন্ডিয়া বা ডিজিটাল ইন্ডিয়া প্রচারে আমাদের নানা ধরণের অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে কতজন দৃষ্টিহীন মানুষ কম্পিউটার শিক্ষার সুযোগ পান?”
আরও পড়ুন
অন্ধত্বের শিকার সন্তান, ৩৫ বছর ধরে দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্রেইল ছাপাচ্ছেন মার্কিন মহিলা
এমনই নানা প্রশ্ন আজও ঘিরে রয়েছে দৃষ্টিহীন নাগরিকদের জীবন জুড়ে। সকলের সমান অধিকারের কথা যেন তাঁদের কাছে আজও এক তামাশা। তবে এতদিন পরেও যে ব্রেইল ইলেকশন স্লিপের বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশন সক্রিয়, তাতে আশাবাদী তাঁরা। শুধু, স্বাধীনতার পর অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে এই সামান্য উদ্যোগের বাস্তবায়ন ঘটাতে।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
হার মেনেছে দৃষ্টিহীনতাও, স্কেটবোর্ডে ভর দিয়েই অলিম্পিকের স্বপ্ন জন্মান্ধ খেলোয়াড়ের