তিরিশের দশকের কলকাতার অন্যান্য অংশের মতোই ছিমছাম একটি ঘর। সেখানে বসে একমনে সেতার বাজাচ্ছেন জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সুরের প্রতি টান ছিল বরাবর। তাই তো এই ঝর্ণাধারার কাছে ফিরে আসেন প্রতিবার। রেওয়াজ করতে করতে কখনও চোখ চলে যেত একটু দূরে। ঘরে গুটিগুটি পায়ে কখন যে হাজির হয়েছে তাঁর ছোট্ট ছেলেটি। বছর চারেক মাত্র বয়স, তার মধ্যেই সেতারের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ। বাবা জিতেন্দ্রনাথ বারবার সরিয়ে রাখেন; পাছে সেতারটি পড়ে যায় বা তারে হাত কেটে যায়। কিন্তু এই ছেলেকে যে থামিয়ে রাখা যাবে না! নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মই যেন সেতারের সঙ্গে ঘর-সংসার করার জন্যে…
সেই চার বছরের ছেলেটির সুরের ছোঁয়ায় মোহিত হয়ে গিয়েছিল গোটা ভারত। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে ‘পণ্ডিত’ হয়ে ওঠা, রাগ-রাগিনীর গলিতে তাঁর যাত্রা সবটাই যেন ম্যাজিক। এই পথচলা তো একদিনে হয়নি। সেই চার বছর বয়স থেকেই সূত্রপাত। তবে বেশিদিন দূরে দূরে থাকতে হয়নি। ছেলের উৎসাহ দেখে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই কাছে ডেকে নিলেন। কতই বা বয়স, বছর পাঁচেক! তখন থেকেই শুরু হল সঙ্গীতের যাত্রা। নিজের হাতে করে সেতারের অ-আ-ক-খ শিখিয়েছিলেন জিতেন্দ্রনাথ…
একটু একটু করে গুরুর সংখ্যাও বাড়ছিল। মহারাজ কুমার বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্র, উস্তাদ মুস্তাক আলি খাঁ— একের পর এক ঘরানায় প্রস্তুতি চলছিল নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের। মাত্র নয় বছর বয়স তখন। সর্বভারতীয় সেতার পরীক্ষায় সফল হয়েছেন ছোট্ট নিখিল। সঙ্গে সঙ্গে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র শিল্পী হিসেবে নিযুক্ত করা হল তাঁকে। এই বয়সেই এমন পরিচিতি। তবে আসল গন্তব্যের তখনও অনেকটা দেরি। নানা রাস্তা ধরে যেতে যেতে একসময় হাজির হলেন আরেক উস্তাদজি। তাঁর পরিচয় তিনি নিজেই— উস্তাদ বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব।
নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় তখন নেহাতই কিশোর। তাতে কী হয়েছে? উস্তাদজি দেখবেন ছেলে আমার ঠিকঠাক কিনা। এবং প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন বাবা আলাউদ্দিন। আরে, এই ছেলের হাত তো বেশ পরিষ্কার! ব্যস, এবার শুরু অনন্ত সাধনার। একটি জন্মে কি এই তপস্যা পূর্ণ হয়? আর সেই সময়ের সেতারের ছবিটা একবার ভাবুন। একদিকে উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ, অন্যদিকে আলাউদ্দিন খাঁ-রই শিষ্য পণ্ডিত রবিশঙ্কর। দুজন উচ্চাঙ্গ সেতারের দুই স্তম্ভ। পরবর্তীকালে তাঁদের সঙ্গীতে, সুরে মাতবে গোটা বিশ্ব। এঁদের মধ্যে থেকে কী করে নিজের জায়গা করবেন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়? কী করে নিজের একটা দুনিয়া তৈরি করবেন?
এর মধ্যে থেকেই স্বতন্ত্র ছাপ রেখেছিলেন তিনি। গানের মধ্যে থেকেই খুঁজে নিতেন দর্শনকে। দেখতে চাইতেন নিজেকে। তাই তো ফিরে গেছেন রবীন্দ্রনাথের কাছেও। একদিন শান্ত হয়ে শুনছেন ‘আজি এ আনন্দ সন্ধ্যায়’। শুনতে শুনতে তাঁর মাথাতেও ঘরতে লাগল একটি বিশেষ সুর। আহা! ক্রমশ ডুব লাগালেন রাগে। রবীন্দ্রনাথের সেই রাগ থেকে নিজেই নিয়ে নিলেন নতুন সৃষ্টি। তৈরি করলেন ‘পূরবীকল্যাণ’ রাগ। এভাবেই সুরের খনি থেকে বের করে নিয়ে আসতেন নতুন ছন্দ। যা তাঁর একান্তই নিজের।
সঙ্গীতের থেকে বড়ো আর কি আছে! সুরই যে আসল দেবতা আমাদের। তাই তার কাছে ডুব দিলে অন্য জটিলতার দিকে আর খেয়ালই থাকে না! সাধনা জিনিসটি কী, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাধকদের দেখলে তা বোঝা যায়। তখন তিনি রীতিমতো বিখ্যাত; সঙ্গীতের জগতে একটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে। তবুও রেওয়াজ আর শেখার রাস্তা থেকে সরে যাননি। কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই জীবনে। তোমাকে শিখতে হবে, আরও গভীরে যেতে হবে। তবে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজেরও একটা নিয়ম ছিল। নতুন কিছু তৈরি করতে গেলে আগে পুরনোকে জানতে হবে। তার চর্চা করতে হবে। বাঁধ ভাঙার গান গাওয়ার আগে বাঁধটিকে তো ভালোভাবে জানতে হবে!
আরও পড়ুন
যুগলবন্দিতে পণ্ডিত যশরাজকে ডাকলেন ভীমসেন যোশী, বলিউডের গানেও মুগ্ধ তামাম শ্রোতা
১৯৮৬ সাল। কতই বা বয়স, মাত্র ৫৪ বছর। এটাই কি চলে যাওয়ার বয়স? এভাবে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারলেন পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়? কিন্তু নিয়তিকে কি ফাঁকি দেওয়া যায়! কিন্তু এই স্বল্প জীবনেও তিনি যা দিয়ে গেছেন, তা মাথায় করে রাখার মতো। পণ্ডিত রবিশঙ্করের মতো বটবৃক্ষের পাশে তিনিও যে অশ্বত্থসম!
তথ্যসূত্র –
১) ‘‘ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতা এক নয়’— বলেছিলেন পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি’, পিয়ালী বসু, বঙ্গদর্শন
২) ‘A gifted maestro and his rich musical legacy’, Shailaja Khanna, The Hindu
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মেঘমল্লার গেয়ে বৃষ্টি নামিয়েছেন পণ্ডিত যশরাজ, টোড়ি শুনে দাঁড়িয়ে পড়ত হরিণের দল