ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অন্যতম বিখ্যাত ঘরানা বিষ্ণুপুর ঘরানা। অষ্টাদশ উনিশ শতকে বেশ জনপ্রিয়তা থাকলেও, ক্রমশ খেয়াল ঘরানার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে বিষ্ণুপুর ঘরানা। তবে শিকড় আঁকড়ে বাঁচতে চাওয়া মানুষও তো খুব কম নয়। তেমনই একজন পণ্ডিত মণিলাল নাগ। এ-বছর ৭ তম প্রজাতন্ত্র দিবসে পদ্মশ্রী সম্মান পেলেন তিনি। তাঁর এই স্বীকৃতিতে বাঙালি হিসাবে গর্বিত তো সকলেই। কিন্তু ৮১ বছর বয়সেও প্রচারের আলোয় আসেননি এই শিল্পী। আজীবন নিঃশব্দে চর্চা করে গেছেন। তাঁর প্রতিভার সাক্ষী থেকেছে নানা দেশ। পেয়েছেন বহু সম্মান। কিন্তু তারপরেও কতটুকুই বা জানি আমরা তাঁর বর্ণময় জীবনের সম্পর্কে?
১৯৩৯ সালে বাঁকুড়া জেলায় জন্ম মণিলাল নাগের। পিতা গোকুল নাগের কাছেই সেতার শিক্ষার শুরু। গোকুল নাগ নিজেও একজন খ্যাতিমান শিল্পী ছিলেন। পেয়েছিলেন 'ভুয়ালকা' সম্মান। একসময় পণ্ডিত উদয় শঙ্করের সঙ্গেও কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন গোকুল নাগ। তবে বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে পরিবারের সায় ছিল না। উত্তরপাড়ায় জমিদার বাড়িতে ছোটো ছেলেমেয়েদের সঙ্গীত শিক্ষক হিসাবে কাজ করতেন তিনি। গোকুল নাগের সঙ্গে উত্তরপাড়াতেই থাকতেন পণ্ডিত মণিলাল নাগ।
১৯৫৩ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলনে আত্মপ্রকাশ পণ্ডিত মণিলালের। তারপর সারাজীবন সেতারকেই আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি। ১৯৫৪ সাল থেকে আকাশবাণীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে আইসিসিআর কর্তৃক দেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন শহরে সেতার পরিবেশন করেন। ১৯৭৯ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকার আয়োজন করেন ভারত মহাসাগর আর্ট ফেস্টিভ্যাল। সেখানেও ভারতের প্রতিনিধি দলের মধ্যে ছিলেন মণিলাল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে তবলায় সঙ্গত করেছেন পণ্ডিত সমতা প্রসাদ, পণ্ডিত কিষাণ মহারাজ, ওস্তাদ কেরামতউল্লা খানের মতো শিল্পীরা। ওস্তাদ আমির খান, গিরিজা দেবীর মতো শিল্পীদের সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের পক্ষ থেকে পেয়েছেন সিনিয়র ফেলোশিপ সম্মান। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক আলাউদ্দিন পুরস্কার এবং ২০১৫ সালে বঙ্গ বিভূষণ এবং সংগীত মহাসম্মান পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। আইটিসি সঙ্গীত সম্মাননা, ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মাননার মতো সম্মানও অর্জন করেছেন তিনি।
কিন্তু এইসব খ্যাতি অর্জনের পরেও পরিচিতির আড়ালে থেকে আজও শিল্পের চর্চা করে যাচ্ছেন মানুষটি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একসময়ের জনপ্রিয় এই ঘরানাটির অবক্ষয়ে চিন্তিত তিনি। আক্ষেপ প্রকাশ করেন বর্তমান প্রজন্মের ইতিহাস বিমুখতা দেখে। বিষ্ণুপুর ঘরানাকে সময়োপযোগী করে তোলার পাশাপাশি তার ঐতিহ্য রক্ষার ব্যাপারেও সচেতন তিনি। খবরাখবর রাখেন বর্তমান যুগের শিল্পীদের কাজকর্মের। বুধাদিত্য মুখার্জি, কুশল দাসের সৃষ্টিতে আশাবাদী তিনি। কিন্তু তাঁর মনে হয়, বর্তমানে শিল্পের ঐতিহ্যের থেকে কারুকার্যই মুখ্য হয়ে উঠছে। শিল্পীর কন্যা মিতা নাগ নিজেও শৈশব থেকেই সেতার শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। দেশবিদেশে তাঁর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। নিজের কন্যার ব্যাপারেও আশাবাদী শিল্পী মণিলাল নাগ। সেতার শিল্পে পুরুষ শিল্পীদের পাশাপাশি মহিলাদের এগিয়ে আসাটাও ভীষণভাবে জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
জীবনের শেষে এসে তাঁর পদ্মশ্রী পুরস্কার লাভ উচ্ছসিত গোটা রাজ্য। তবে তিনি নিজে তেমন উচ্ছাস প্রকাশ করেননি। বরং শিল্পের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকতেই আগ্রহী শিল্পী মণিলাল নাগ।