তিনি ভারতে জন্মাননি, কিন্তু ভারতের জন্য জন্মেছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। সে-সময় তাঁর লেখা প্রবন্ধ হাজার হাজার তরুণকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি ভগিনী নিবেদিতা (Sister Nivedita)। বেশিরভাগই তাঁকে কেবল স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য হিসেবে জানেন। ইতিহাস তাঁর প্রতি সুবিচার করেনি। ভারত সেবার সংকল্প এবং ভারতীয়দের জন্য তিনি যে আত্মত্যাগ করেছিলেন, তা কীভাবে ভুলে যেতে পারি আমরা?
নিবেদিতার লেখা ‘কালী দ্য মাদার’, ‘দ্য ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ’, ‘ক্র্যাডল টেলস অফ হিন্দুইজম’, ‘অ্যান ইন্ডিয়ান স্টাডি অফ লাভ অ্যান্ড ডেথ’, ‘মিথস অফ হিন্দুস অ্যান্ড বুদ্ধিস্টস’, ‘ফুটফলস অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ ইত্যাদি বই পড়লে বোঝা যায় লেখক ভারতের ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি, স্থাপত্যের মতো বিষয়গুলিকে কীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি কেবল ভারতের সমস্যাগুলিই আলোচনা করেননি, বাতলে দিয়েছেন সমস্যার সমাধানের পথও। ‘দ্য ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ’ গ্রন্থে ভারতের বর্ণব্যবস্থা নিয়ে সরব হয়েছেন। তাছাড়াও সমাজে নারীদের অবস্থানের কথাও বইটিতে আলোচ্য। উক্ত প্রবন্ধ সংকলনের ভূমিকা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের ‘কালী দ্য মাদার’ পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতমাতার ছবি আঁকেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উত্তর আয়ারল্যান্ড থেকে তিনি ভারতে এসেছিলেন ১৮৯৮ সালে। আর ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে পাশ্চাত্য জগৎকে পরিচয় করানোর জন্য রচনা করেছিলেন ‘ক্র্যাডল টেলস অফ হিন্দুইজম’। ১৯০২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নিবেদিতা ভারতে স্বাধীনতার জন্য জনসচেতনতার কাজ শুরু করেছিলেন। লিজেন্ড রেমন্ডের লেখা সিস্টার নিবেদিতার জীবনী ‘দ্য ডেডিকেটেড - আ বায়োগ্রাফি অফ সিস্টার নিবেদিতা’ অনুসারে, ১৯০২ সালের ২০ অক্টোবর বরোদায় পৌঁছেছিলেন তিনি। এখানে তিনি অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অরবিন্দের বয়স তখন ৩০। নিবেদিতা তাঁকে কলকাতায় এসে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানান এবং এর প্রয়োজনীয়তাও ব্যাখ্যা করেন। পরবর্তী সময়ে অরবিন্দ এবং নিবেদিতা স্বাধীনতার জন্য একসঙ্গে কাজ করেছেন। ১৯০২ সালে মহাত্মা গান্ধিও সিস্টার নিবেদিতার সঙ্গে কলকাতায় দেখা করেছিলেন। ১৯০৪ সালে ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকার রূপদান করেছিলেন নিবেদিতা। লাল চতুষ্কোণাকার এই পতাকার কেন্দ্রে ছিল বজ্র এবং শ্বেতপদ্ম সংবলিত একটি হলুদ ইনসেট। পতাকায় বাংলায় লেখা ছিল ‘বন্দেমাতরম’। ১৯০৬ সালে পতাকাটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আয়োজিত একটি প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছিল। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু (যিনি পরবর্তীতে এই পতাকা কলকাতায় তাঁর বোস ইনস্টিটিউশনের প্রতীক বানিয়েছিলেন) এর ব্যবহার শুরু করেছিলেন এবং পরে এটি ভারতের সর্বোচ্চ সামরিক পুরস্কার পরম বীর চক্রের নকশায় গৃহীত হয়।
১৯০৬-০৭ সালে তিনি ব্রিটিশ সরকারের অনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে ভারতীয় সমাজকে সচেতন করার জন্য নিয়মিত নিবন্ধ লিখতে শুরু করেন। এগুলি প্রবুদ্ধ ভারত, সন্ধ্যা এবং নিউ ইন্ডিয়ার মতো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। অরবিন্দের সঙ্গে তিনি যুগান্তর, কর্ম যোগিন, বন্দে মাতরম-এর মতো সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে কাজ করেছিলেন। কেবল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসুও জাতীয়তাবাদী চিত্রকর্ম তৈরি করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতাকে দেখেই।
আরও পড়ুন
নিজে হাতে বন্দুক চালাতে শেখান মহিলাদের, বাংলার বিপ্লববাদের সঙ্গে জড়িয়ে নিবেদিতার ভূমিকা
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলা ভাগ করেন। বাংলায় স্বদেশি আন্দোলনের শিঙাও বাজে একইসঙ্গে। নিবেদিতাও এতে অংশ নেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় গোপনে বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন নিবেদিতা। জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব বোঝাতে সেই সময় নানান জনসভার আয়োজন করা হত। নিবেদিতা সেইসব জনসভায় আমন্ত্রিত হয়ে এসে মানুষকে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার বার্তা দিতেন। ১৯০৫ সালে গোপালকৃষ্ণ গোখলের সভাপতিত্বে বেনারসে কংগ্রেসের অধিবেশন আয়োজিত হয়। আমন্ত্রিত ছিলেন ভগিনী নিবেদিতাও।
আরও পড়ুন
'সূর্যোদয়' দেখতে চেয়েছিলেন নিবেদিতা, মৃত্যুর পর শুধু অবহেলাই দিল দার্জিলিং!
বাগবাজারের তাঁর বাড়িটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, অরবিন্দ ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বদের মিলনস্থল হয়ে ওঠে। তাঁর প্রশংসকদের মধ্যে বিপ্লবীদের পাশাপাশি উদীয়মান শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরাও ছিলেন। রমেশচন্দ্র দত্ত এবং যদুনাথ সরকারের মতো লেখককে ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস লিখতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। গোখলে বলেছিলেন, নিবেদিতার সঙ্গে দেখা করা ‘প্রকৃতির কোনো দুর্দান্ত শক্তির সংস্পর্শে আসার মতো’। তামিল জাতীয়তাবাদী কবি সুব্রহ্মণ্যম ভারতী মাত্র একবার দেখা করেছিলেন নিবেদিতার সঙ্গে। ‘গুরু’র মর্যাদা দিয়ে সিস্টার নিবেদিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তিনি আমাকে ভারতমাতার পরিপূর্ণতা দেখিয়েছিলেন।’ ব্রিটিশ সরকার যখন বন্দেমাতরম গাওয়া নিষিদ্ধ করে, তখনও তিনি তাঁর স্কুলে চালু রাখেন এই সংগীত।
ভারতীয় শিল্পীদের উৎসাহিত করার জন্য বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট প্রতিষ্ঠা হয় নিবেদিতার হাত ধরেই। ১৮৯৯ সালে কলকাতায় প্লেগ মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় যুবকদের সহায়তায় রোগীদের সেবাশুশ্রূষা এবং পল্লী পরিষ্কারের কাজ করেন। ১৯০৬ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষের সময়েও মানুষের পাশে দাঁড়ান। ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এরপর তিনি নিজেই ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন ‘মানুষের জননী’, যাঁর জীবন ভারতের জন্য উৎসর্গকৃত। বাস্তবেই ভারতমাতার পরিপূর্ণ রূপ ভগিনী নিবেদিতা।
Powered by Froala Editor