তিনি ইংরেজির অধ্যাপক—শহরজোড়া নামডাক। তাঁর ক্লাস শুনতে বিদ্যাসাগর কলেজ তো বটেই, ভিড় জমায় অন্য কলেজের পড়ুয়ারাও। এই মানুষটি একদিন ঠিক করলেন, অধ্যাপনা ছেড়ে থিয়েটার করবেন পেশাদারভাবে। সেই সময়ে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে বাংলা থিয়েটারে আজকের মতো ‘শিক্ষিত’ মানুষের একচ্ছত্র শাসন ছিল না। থিয়েটারের দর্শক মূলত গ্রামগঞ্জ ও শহরের খেটে-খাওয়া তথাকথিত নিচুতলার মানুষ। আর অভিনেত্রীদের একটা বড়ো অংশ শহরের পতিতাপল্লী থেকে উঠে আসা। পরিচিতরা ইংরেজির অধ্যাপকের সিদ্ধান্তে অখুশি হলেন, বাধাও দিলেন অনেকে। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। শুধু থিয়েটার করবেন না, তার সঙ্গে বদলে দেবেন বাংলা থিয়েটারের ভিতরকার পরিবেশকেও।
তিনি অর্থাৎ শিশিরকুমার ভাদুড়ি (Sisir Kumar Bhadury) যখন ১৯২৩ সালে পেশাদার থিয়েটারে ‘সীতা’ নাটক অভিনয় করছেন, তখন তাঁর পাশে চাঁদের হাট। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, যামিনী রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে তাঁর নাট্যসঙ্গী। দর্শকাসন থেকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নাট্যাচার্য অমৃতলাল বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে উঠলেন শিশির ভাদুড়ির ভক্ত। কলকাতার মানুষের মুখে তখন শুধু ‘সীতা’র কথা, আর শিশির ভাদুড়ি হয়ে উঠলেন নতুন প্রজন্মের ‘আইকন’। পরে হয়ে উঠবেন বাংলা থিয়েটারের ‘নাট্যাচার্য’ ‘বড়োবাবু’। গিরিশচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে একই পংক্তিতে উচ্চারিত হবে তাঁর নাম।
১৮৮৯ সালের ২ অক্টোবর তাঁর জন্ম। নেহাতই শৌখিনভাবে থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া ছাত্র ও অধ্যাপক জীবনে। ১৯১২ সালে প্রয়াত হন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে বাংলা থিয়েটার। ১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। চারদিকে অবক্ষয়, অর্থাভাব; আয় কমছে থিয়েটারের। সেই নায়ক কোথায়, যাকে দেখে আস্থা পাবে মানুষ? চলছে একই নাটকের চর্বিতচর্বণ, প্রযোজনা বা অভিনয়রীতিতেও পুরনো পদ্ধতি দেখে দেখে মানুষ ক্লান্ত। থিয়েটার দলগুলির মধ্যে নোংরা দলাদলি। মঞ্চের পিছনের জীবনেও সুস্থতার অভাব। সেই সময়ই আবির্ভাব হল শিশিরকুমারের। অধ্যাপনার পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে কিছুদিন অভিনয়ের পর আসে ম্যাডান কোম্পানির ১০০০ টাকা বেতনের ‘ড্রামাটিক ডিরেক্টর’ হওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব। ম্যাডানরা মূলত সিনেমা বানাত, থিয়েটারের বাজার দেখে কয়েকটি স্থূল রুচির নাটক করারও চেষ্টা করেছিল। সেসব ব্যর্থ হওয়ায় শিশিরকুমারের শরণাপন্ন হয় তারা। কিন্তু ব্যবসায়িক মানসিকতার কাছে শিল্পকে বারবার অপমানিত হতে দেখে শেষ পর্যন্ত ম্যাডানদের সঙ্গ ছাড়তে হয় তাঁকে।
তারপরই হাত দিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সীতা’ নাটকের অভিনয়ে। ইডেন গার্ডেনসে ‘সীতা’ অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে শোরগোল পড়ে গেল কলকাতায়। তৈরি করলেন নিজস্ব নাট্যদল—‘নাট্যমন্দির’। স্টার, ন্যাশনাল, মিনার্ভা, ক্লাসিক, এমারেল্ডের মতো বিদেশি নাম নয়, খাঁটি বাংলা নাম। নাট্যদল হয়ে উঠল ‘মন্দির’। শুধু ব্যবসা নয়, থিয়েটার হবে পূজার আশ্রয়স্থল। কিন্তু প্রতিপক্ষ আর্ট থিয়েটারের চক্রান্তে হাতছাড়া হয়ে গেল সে নাটকের স্বত্ব। এখন উপায়? কয়েকদিনের মধ্যে যোগেশ চৌধুরীকে দিয়ে নাটক লিখিয়ে ১৯২৪-এর আগস্ট মাসে অভিনীত হল নতুন ‘সীতা’ নাটক। এল চূড়ান্ত সাফল্য আর জনপ্রিয়তা। সে অর্থে ‘পরিচালক’-এর ধারণা বাংলা নাটকে আগে ছিল না, অজানা ছিল সম্মিলিত অভিনয়ের পদ্ধতি। শিশিরকুমারের হাতে থিয়েটারে এল নবযুগের বার্তা।
আরও পড়ুন
অর্থই অনর্থ : শিবরাম-শরৎচন্দ্র দ্বন্দ্ব এবং শিশির ভাদুড়ির বক্তব্য
এরপর অভিনীত হল ‘পাষাণী’, ‘জনা’, ‘বিসর্জন’, ‘প্রফুল্ল’, ‘ষোড়শী’, ‘সাজাহান’, ‘বলিদান’-এর মতো নাটক। খ্যাতি এল, কিন্তু ঘরে অর্থ এল কি? পেশাদার থিয়েটারের আগুনে ক্ষুধাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য যে ‘কায়দা’-র প্রয়োজন, তার থেকে বেশ খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের নাটককে যথাযথভাবে পেশাদার মঞ্চে তুলে আনার সাহস তাঁর। সাধারণ দর্শক কি তৈরি ছিল নতুন রুচির স্বাদ পাওয়ার জন্য? আর শিশিরকুমার নিজেও তো বলতেন, “আমি ব্যবসা বুঝি না”। সব মিলিয়ে কিছুদিনের মধ্যে ধারদেনায় ডুবে গেল ‘নাট্যমন্দির’। শেষচেষ্টা করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘তপতী’ নাটক দিয়ে। কবিগুরু স্বয়ং পরিমার্জনা করে দিলেন ‘রাজা ও রাণী’ নাটকটিকে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হল ‘তপতী’। ১৯৩০-এ উঠে গেল স্বপ্নের নাট্যমন্দির।
আরও পড়ুন
সত্যজিৎ রায়কে ‘গুরু’ শিশির ভাদুড়ীর গল্প শোনাতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
মঞ্চহীন ‘নাট্যসম্রাট’ পাড়ি দিলেন আমেরিকায়। সেখানকার বিখ্যাত ভ্যান্ডারবিল্ড থিয়েটারে ‘সীতা’ নাটকের আমন্ত্রণমূলক অভিনয়ের জন্য। নানারকম বাধা এল সেখানেও। প্রশংসা পেলেন, কিন্তু টাকার মুখ দেখা হল না। সে গল্প আজ থাক। দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই পেলেন আদালতের সমন। নাট্যমন্দির চালানোর জন্য হিন্দুস্থান কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতেন শিশিরকুমার। তার সঙ্গে চড়া সুদে ‘হুন্ডি’ কেটে বা হ্যান্ডনোটে ধার নিতেন অনেকের থেকে। এদিকে তাঁর তখন কপর্দকশূন্য অবস্থা। তাঁর নামে জারি হল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। ১৯৩৩-এর ২৫ জুলাই বাংলা থিয়েটারের ‘নাট্যাচার্য’-কে গ্রেপ্তার করে হাজির করা হল আদালতে। কোনো আইনজীবী নেই তাঁর, সামর্থ্য নেই নিয়োগ করার। বিচারপতিকে খুলে বললেন সমস্ত ঘটনা। তার পরদিনই নিজেকে ‘দেউলিয়া’ ঘোষণা করলেন তিনি। সে যাত্রায় হয়তো জেল যাওয়া থেকে বেঁচে গেলেন, কিন্তু পরবর্তীতে আর কোনো প্রতিষ্ঠানের থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়ার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।
আর্থিক সমস্যা কোনোদিনই পিছু ছাড়েনি তাঁর। প্রকাশ্য দিবালোকে নবনাট্যমন্দির থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে তাঁর সমস্ত সরঞ্জাম। স্বাধীন দেশের স্বাধীন সরকার কেড়ে নিয়েছিল ‘শ্রীরঙ্গম’-এর মঞ্চে। ‘ভাড়াটে কেষ্ট’-এর মতো ঘুরে বেড়াতে হয়েছে বিভিন্ন দলে। ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান দিয়েছিল। আজীবন শুধু নিজস্ব একটা মঞ্চের প্রার্থনা ছিল তাঁর। সাহায্য করেনি কেউ, আজ ‘প্রিন্সিপাল’-এর খাতিরে তিনিও ফিরিয়ে দিলেন সেই সম্মান। ওই বছরই মৃত্যু ঘটে তাঁর। ভারত সরকারকে পাঠানো চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন,
“If the government really wished to honour me and through myself, the cause I have served for nearly forty years, a more befitting tribute would have been the gift of a public stage to the city of Calcutta. For it too late to retrieve the theatre I have lost.”
কী পেলেন তিনি থিয়েটারকে সবকিছু দিয়ে? সম্মান, জনপ্রিয়তা, ভালোবাসা? নাকি আদৌ কিছুই চাননি এসব। শুধু নাটক করে যেতে চেয়েছেন আজীবন। মঞ্চই যেন শেষ সমাধি হয় তাঁর। থিয়েটারের রং যাঁর মুখে একবার লেগেছে, তিনি তো বারবার ফিরে আসবেনই স্পটলাইটের তলায়। ধাক্কা খাবে আলোর দিকে যেতে গিয়ে। আর তখন যেন বাংলা থিয়েটারের ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ শিশিরকুমার ভাদুড়ি তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন আদর্শ উদাহরণ হয়ে।
ঋণস্বীকার : বাংলা থিয়েটার ও নাট্যাচার্য শিশিরকুমার, অনিল মুখোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor