পঞ্চাশের দশক। বাংলার চলচ্চিত্র জগতের অন্দরে বইছে স্বর্ণযুগের হাওয়া। একের পর এক অবিস্মরণীয় গান, সিনেমা উপহার পাচ্ছে মানুষ। আর কারা আছেন সেখানে? মান্না দে, শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরীর মতো ভারতখ্যাত নাম। বাঙালিদেরই তখন রাজত্ব গোটা দেশ জুড়ে। মনে পড়ে সেই গানটির কথা? ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি’… তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা, সঙ্গে মান্না দে’র গায়কি। প্রায় ওই সময়ই গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আরও একটি গান লিখেছিলেন। ‘ওগো তোমার…’-এর মতোই তার ভাব, কথার ধরণ। কিন্তু এই গান কাকে দিয়ে গাওয়াবেন পুলকবাবু? মাথার মধ্যে চলে এল শচীন দেববর্মণের নাম। চলেও গেলেন বম্বে। কিন্তু ব্যস্ত থাকার জন্য সেই গানে সময় দিতে পারলেন না শচীনকর্তা। এবার উপায়? পুলকবাবুর মনে পড়ল কলকাতার এক বন্ধুর কথা— অখিলবন্ধু ঘোষ। অসামান্য গানের গলা তাঁর, তেমনই সাধনা। অতঃপর, তাঁকে দিয়েই গানটি গাওয়ানো হল। গানটি ছিল ‘ও দয়াল বিচার করো’…
গানটির নাম করার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই হয়তো সুরটি গুনগুন করে উঠলেন। সেই জন্মলগ্ন থেকে বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গেও জড়িয়ে গেছে গানটি। কিন্তু তাঁর পেছনের গলাটিকে কি চিনতে পারবে, বাঙালি? অখিলবন্ধু ঘোষ এমন একটা সময় বাংলার গানের জগতে এসেছিলেন, যখন প্রতিভার ছড়াছড়ি। তিনি নিজেও ছিলেন সাধকের মতোই। গান আর সুরই ছিল আরাধ্য ভগবান। অথচ জীবিতকালে সেরকম পরিচিতিই পাননি তিনি। অবশ্য আমরাও কি মনে রেখেছি, এই বছরই তাঁর জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে…
ছোটো থেকেই একটু লাজুক প্রকৃতির ছেলে ছিলেন অখিলবন্ধু। ভবানীপুরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠেছিল ছোটবেলা। সারাটা জীবন ধরে এই ‘মধ্যবিত্ত’ তকমাটিই বয়ে নিয়ে চললেন তিনি। ম্যাট্রিক পাশ করার পরেই থেমে গিয়েছিল পড়াশোনা। আর্থিক অনটনই একমাত্র কারণ নয়; তিনি নিজেই আর এগোতে চাননি। ততদিনে গান যে তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে! এ নেশা যে তীব্র নেশা। সঙ্গে পেয়েছিলেন আরেক বন্ধু, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। দুজনের বেড়ে ওঠাও প্রায় একইসঙ্গে। অথচ অদৃষ্টের অদ্ভুত নিয়ম! হেমন্ত যেখানে বাংলা তথা ভারতের সঙ্গীত জগতে কিংবদন্তিসম, সেখানে অখিলবন্ধু ঘুরে বেরিয়েছেন বিস্মৃতির আড়ালে…
একেবারেই কি বিস্মৃত ছিলেন তিনি? কবীর সুমন লিখেছিলেন, ‘তারই ফাঁকে কোথায় যেন অখিলবন্ধু ঘোষের গলা’। তারপর থেকে একটু একটু করে যেন পর্দা সরল জীবনের। ততদিনে অখিলবন্ধু প্রয়াত। কিন্তু তার আগে? পঞ্চাশের ‘সোনায় মোড়ানো’ সময়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ছোটো আকারের হলেও অখিলবন্ধুকে ঘিরে একটি দল তৈরি হয়েছিল। ওঁর মতো গলার সূক্ষ্ম কাজ কি করতে পারবে কেউ? লড়াইয়ের ভঙ্গি থাকলেও, কথাটা যে কতটা বাস্তব তা স্বীকার করেছিলেন স্বয়ং কবীর সুমনও। দেখনদারি নেই; ছোটো কাজ কি অবলীলায় ও সূক্ষ্মতার সঙ্গে করে ফেলছেন তিনি! কানে হয়ত এই সময় বেজে উঠবে ‘ওই যে আকাশের গায়ে’। যেন মেঘেদের গা ধরে উড়ে চলা মুক্ত পাখিদের দেখেই বলে উঠছেন ‘ওরা চঞ্চল, ওরা উদ্দাম’। নিজের বন্ধুর সম্পর্কে বলতে গিয়ে বারবার এই ভাব, এই সূক্ষ্মতার কথাই বলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও।
মামা কালিদাস গুহ-র কাছেই গান শেখার শুরু। পরবর্তীকালে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখার জন্য নানা গুরুর কাছে গিয়েছেন অখিলবন্ধু। একটা সময় আচার্য চিন্ময় লাহিড়ীর কাছেও শিখেছেন রাগ-রাগিণীর চর্চা। সেসব নিজেকে আরও ধারালো করার জন্য। গানের প্রতি সহজাত দখল তো ছিল সেই ছোটো থেকেই। আক্ষেপ, বাংলা চলচ্চিত্র জগত মাত্র তিনটি ছবিতে তাঁকে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু সেসবে ভ্রুক্ষেপও ছিল না তাঁর। কখনও ভজন, কখন রবীন্দ্রনাথ, আবার কখনও নজরুল— নানা মাঠে অবাধ বিচরণ করেছেন তিনি। আবার নিজেই তৈরি করেছেন সুর, গেয়েছেন সেই গানও। মনে পড়ে ‘আজই চাঁদিনি রাতি গো’ গানটির কথা। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় নিজেই সুর দিয়েছিলেন অখিলবন্ধু। চোখ বন্ধ করে হারমোনিয়াম বাজিয়ে যাচ্ছেন তিনি, সুরের মোচড়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন সকলের। এইভাবেই গান করেছেন, শিখিয়েছেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। ওইটুকুই। তার বেশি কিছু চানওনি, সমাজও দেয়নি…
সঙ্গীত জীবনে সহযাত্রী বলতে ছিলেন একজনই, স্ত্রী দীপালি ঘোষ। ঠিক যেন একে অপরের অনুঘটক। তাঁরই সুরে অখিলবন্ধু গেয়েছিলেন বিখ্যাত গান ‘যেন কিছু মনে করো না, কেউ যদি কিছু বলে’। আজও এই গান ভুলতে পারেনি বাংলা। কিন্তু গায়ক রয়ে গেলেন পিছনে। কখনও খারাপ লাগেনি পথ চলার সময়? এমন মায়াবী, দরদী গান গেয়েও জীবিতকালে পিছিয়ে পড়েছিলেন অখিলবন্ধু ঘোষ। খারাপ তো লাগতই। সেসব ভোলানোর একটাই ওষুধ— সুর। শেষ বেলায় গানে গানে হয়তো খানিক বলেও গিয়েছিলেন কষ্টের কথা, ‘সারাটি জীবন কী যে পেলাম এই মায়াভরা পৃথিবীতে’… দেখতে পারছিলেন, সূর্য ক্রমশ ডুব দিচ্ছে পশ্চিমে। আর ঘরের ভেতর একা বসে আছেন অখিলবন্ধু স্বয়ং। বাকিরা যে এগিয়ে গেছে অনেক আগেই…
আরও পড়ুন
পুজোর গান— শারদ অর্ঘ্য
চল্লিশের দশকে বেতারের মাধ্যমে যে গানের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই যাত্রা হঠাৎই শেষ হল গানের মধ্যে দিয়েই। ১৯৮৮ সালের ২০ মার্চ। অণ্ডালে একটি অনুষ্ঠান সেরে বাড়ি ফিরেছিলেন অখিলবন্ধু ঘোষ। হঠাৎই শরীর খারাপ। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে। সেখানেও সঙ্গী অবহেলা। অসুস্থ অখিলবন্ধুর চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টা। পরে তৎপরতার সঙ্গে শুরু হলেও কিছু করার ছিল না। প্রায় চুপিসারেই চলে গিয়েছিলেন তিনি। ওই যে, নিজের সম্পর্কে যে কিছুই বলতেন না শান্ত মানুষটা। কথা বলতেন চোখ বুজে, একমনে সুর বাজিয়ে। গানই যে তাঁর সাধনা। আর যে কিছুই পাওয়ার নেই অখিলবন্ধু ঘোষের…
তথ্যসূত্র –
১) ‘শতবর্ষে অখিলবন্ধু’, অভীক চট্টোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘চন্দ্রিলিয়ে ৫’, কবীর সুমন, sumanami.co.uk
৩) ‘বাংলা আধুনিক গানের আভিধানিক ভাষ্য’, ভবভূতি ভট্টাচার্য, পরবাস
৪) ‘অখিলবন্ধু ঘোষ’, সন্দীপ মুখোপাধ্যায়
আরও পড়ুন
সলিল চৌধুরীর গান গাইলে থাকা যাবে না শান্তিনিকেতনে, রেকর্ডিং করেও পিছিয়ে এলেন কণিকা
Powered by Froala Editor