সিমোন বাইলস কি একটা অজানা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছেন?

আমাদের বরাবর আলো নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কারণ আলো পথ দেখায়। কিন্তু সেই আলো যদি কোনো আঁধারের সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে, তবে তা টিমটিম করে জ্বলে। প্রয়োজন হয় আঁধারকেও ভালো করে চিনে নেওয়ার। কারণ সেই আঁধারকে না চিনলে, তাকে দূর করার জন্য ইচ্ছে না জাগলে, যে আলো জ্বলে তা বহুদূর অবধি ছড়িয়ে পড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের মতো খেলাধূলার জগতেও এটা সত্যি।

আসুন আলোর আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠার পথ অনুসন্ধান করতে একটু আঁধারের দিকে ফিরে তাকাই।

২০২১ টোকিও অলিম্পিকে সিমোন বাইলসের বেশ কয়েকটি ইভেন্ট থেকে নাম তুলে নেওয়া ক্রীড়াবিশ্বে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন তৈরি করেছে। এমনকি ক্রীড়াবিশ্বেরও পরিসর অতিক্রম করে গেছে ঘটনাক্রম। 

কে সিমোন বাইলস? কী সেই আলোড়ন? কেন সেই আলোড়ন? কেন তা অভূতপূর্ব? 

আরও পড়ুন
স্বর্ণপদক ভাগ করে নিলেন দুই প্রতিযোগী, বিরল বন্ধুত্বের সাক্ষী অলিম্পিকের মঞ্চ

সিমোন বাইলসের নাম হয়তো মিডিয়ার সূত্রে অনেকেই জেনে গেছেন। ক্রীড়াবিশ্বের অন্যতম নক্ষত্র। আর্টিস্টিক জিমন্যাস্ট। শুধু কী এটুকুই? না! আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্সের সর্বকালের অন্যতম সেরা কিছু জিমন্যাস্ট, যেমন নাদিয়া কোমানেচি, একতারিনা জাবো, মেরি রেটন লৌ প্রমুখরা প্রায় সকলেই স্বীকার করে নিচ্ছেন যে এখনও অবধি পৃথিবীর সর্বকালের সেরা জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলস। বাইলস নিজে চারটে নতুন ভল্টের জন্মদাত্রী যা বাইলস ১,২,৩ ও ৪ নামে পরিচিত। বয়স ২৩। এখনই ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ আর অলিম্পিক মিলিয়ে যা গোল্ড মেডেল পেয়েছেন, তার ধারেকাছে কেউ নেই। আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্সের ব্যালান্স বিম বিভাগে ডাবল-ডাবল ডিসমাউন্ট নামে যে অত্যন্ত কঠিন ভল্টটা তিনি এক্ষেত্রে নিয়ে এসেছেন সেটা যাতে জিমন্যাস্টরা প্রদর্শন না করেন তার জন্য জাজরা তাদের নিরুৎসাহিত করতে এই ভল্টের জন্য পয়েন্ট ইচ্ছে করে কমিয়ে দিয়েছেন। এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ সেই ভল্ট।

আরও পড়ুন
এ যেন অঘটনেরও অঘটন, প্রথমবার অলিম্পিক সেমিফাইনালে ভারতের মহিলা হকি দল

এ তো গেল কিছু তথ্যমাত্র। ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে আসল ব্যাপার হল সৌন্দর্য। যেমন টিকিট কেটে এক মিনিট খেলা দেখার সুযোগ পেলে সিংহভাগ মানুষ লিয়োনেল মেসির খেলা দেখতে যাবেন, যাবেন হেরে যাবে জেনেও রজার ফেডেরারের খেলা দেখতে কিংবা রেকর্ড সব বিরাট কোহলি ভেঙে দিতে পারে জেনেও সচিন তেন্ডুলকরের খেলা। শেষ বিচারে সৌন্দর্য তথা নান্দনিকতা বরাবর মানুষকে ভেতর থেকে আকৃষ্ট করে। সেরকমই হল জিমন্যাস্টিক্স ফ্লোরে সিমোন বাইলসের সার্বিক উপস্থিতি। এই ব্যাপারটা আরো একটা বাড়তি মাত্রা পেয়ে গেছে কারণ তিনি ‘ব্ল্যাক’। কালো মানুষ জিমন্যাস্টিক্স কাঁপাচ্ছে-- এ কথা পৃথিবীর কেউ হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। কালো মানুষদের শারীরিক গঠনও জিমন্যাস্টিক্সের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মুভe করার ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়, এমনটাই মনে করা হত। 

আরও পড়ুন
ছেলেবেলার স্বপ্নপূরণ করতে এসে অলিম্পিকে সোনা গণিতের অধ্যাপকের

আলোড়ন এটা নিয়ে পড়ে গেছে যে বাইলস অলিম্পিক্সে এসে একের পর এক ইভেন্ট থেকে নিজের নাম তুলে নিচ্ছেন। পৃথিবীর ক্রীড়াপ্রেমীদের হতাশার শেষ নেই। বিশ্বকাপ ফাইনালে এসে মেসি না খেললে যেমন হত আর কি! বাইলসের অলিম্পিক্সে এসে মনে হয়েছে যে তার শরীর আর মন এক সুরে নেই। যাঁরা এবারের অলিম্পিক্সের মেয়েদের আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকস বিভাগের কোয়ালিফাইং রাউন্ড দেখেছেন তাঁরা বাইলসের মুখচোখ দেখলেই সেটা বুঝতে পারবেন নিশ্চয়ই। টিম ইভেন্টের ফাইনালে ভল্ট বিভাগে ভল্ট দেওয়ার সময়ই বাইলসের মনে হয় যে তিনি শূন্যে হারিয়ে গেছেন। টু অ্যান্ড হাফ টুইস্ট দিতে গিয়ে দিয়ে ফেলেন ওয়ান অ্যান্ড হাফ টুইস্ট। কে না জানে এই ভল্টগুলি ঠিকভাবে দিতে না পারলে বিশাল মাপের চোট থেকে প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা অবধি থাকে। মুহূর্তের মধ্যে বাইলস টিমমেট এবং কোচের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁর এই মুহূর্তে আর অংশগ্রহণ করা ঠিক হবে না। কারণ তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টিমের পদক পাওয়াই অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। পরিবর্ত হিসেবে সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়েন বাইলসের সঙ্গেই টেক্সাসে অনুশীলন করা টিনএজার জর্ডন চাইলস (সেও কাকতালীয়ভাবে আফ্রিকান-আমেরিকান)। বাইলস তখন চিয়ার করার ভূমিকায়। আর টিমমেটদের জন্য চক আর জল দেওয়ার ভূমিকায়। কমেন্টেটর থেকে শুরু করে অন্যান্য দেশের প্রতিযোগীরা পুরো থ। ইভেন্ট শেষ হওয়ার সময়ও ঘোর যেন কাটছে না। রাশিয়া প্রথম, আমেরিকা দ্বিতীয়, গ্রেট ব্রিটেন তৃতীয়। তারপর ইন্ডিভিজুয়াল ইভেন্টের ফ্লোর, ভল্ট আর আন-ইভেন বার থেকেও নাম তুলে নিলেন মেন্টাল হেলথ কনসার্নের জন্য।

আমেরিকা জুড়ে বাইলসকে লক্ষ্য করে বাঘা বাঘা শব্দ আসতে শুরু করল। গেল গেল রব! আমেরিকার নাম খারাপ করল, ভীতু ইত্যাদি ইত্যাদি। "তুমি চাপ নিতে পারো না, তাহলে তুমি গেছ কেন?" "তুমি বড় না দেশ বড়?" "কালোরা একারণেই বিশ্বাসঘাতক!" মনে পড়ে যাচ্ছে তিন সপ্তাহ আগের ইউরো ফাইনালের পর শাকা, রাশফোর্ড আর স্যাঞ্চোকে নিয়ে ব্রিটিশ ফ্যানদের প্রতিক্রিয়া? 

তবে একটা বড় পরিবর্তন ঘটে চলেছে এই অন্ধকার সময়েও। হয়তো তার রিফ্লেকশন দেখা গেল এই ঘটনার প্রতিক্রিয়াতেও। শুধুমাত্র ঘৃণা নয়, ভালোবাসা উপচে পড়ত শুরু করল আমেরিকা এবং দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে। যে পুঁজিবাদী দুনিয়া তার নিজের মুনাফার প্রয়োজনে স্টারডম নির্মাণ করে এবং মানুষকে সেই স্টারদের মানুষ নয়, হয় ভগবান আর ব্যর্থ হলে শয়তান হিসেবে ভাবতে ইন্ধন জোগায়, তার তো এতে বড়ই মুশকিল। কিন্তু নাদিয়া কোমানেচি, পল পোগবা থেকে শুরু করে পৃথিবীর তাবড় তাবড় ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরা ইতোমধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বাইলসের পাশে দাঁড়িয়ে গেছেন। আমেরিকা জুড়েও বাইলসের পাশে দাঁড়ানোর স্বর যেন একটু বেশিই! হয়তো আমেরিকার ভেতর এক অন্য আমেরিকা মাথা তোলার চেষ্টা করছে। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ ইত্যাদি ইত্যাদি বৃহত্তর পরিসরে সংযুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছে হয়তো। ফলে জিমন্যাস্টিক ফ্লোরে বাইলসের এক মুহূর্তের উপস্থিতি যাদের কাছে হাজার হাজার লাখ লাখ কোটি কোটি ডলারের মুনাফার আরেক নাম, সেই কর্পোরেট স্পনসর থেকে শুরু করে কর্পোরেট মিডিয়াদের এই পরিস্থিতি যেন বা একটু হজম করে নিতে হচ্ছে। 

আসলে আমরা ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের তৈরি করা আলোর পেছনে তাদের যে আঁধারে কাটাতে হয়, সেটা খুব একটা দেখতে পাই না। দেখানো হয় না। চেপে দেওয়া হয়। তাদের ওপর সারাক্ষণ চাপ তৈরি করে যায় স্পনসররা। অমানুষিক চাপ। মানবিক সত্তা থেকে বেরিয়ে গিয়ে এক কল্পিত বিমূর্ত দেশপ্রেম মাখানো এভারেস্টে ওঠার চাপ, যেখানে পৌঁছতে পারলেই নাকি পরম সার্থকতা! তার জন্য তাদের সর্বস্ব ঢেলে দিতে হবে। তাদের ভুলে যেতে হবে যে তারা জীবন্ত এক মানবিক সত্তা। তাদের এই 'এভারেস্ট'-এ ওঠার জন্য যাবতীয় ইক্যুইপমেন্ট, খাবার দাওয়ার, এনার্জি ড্রিঙ্ক ইত্যাদি সরবরাহ করবে এই কর্পোরেটরা। বিনিময়ে তাদের পারফর্ম করে যেতে হবে। দেশের লোককে দিয়ে আমি তোমায় হাততালি দেওয়ানোর সমস্ত বন্দোবস্ত করব। তবে পারফর্ম তোমাকে করতেই হবে। ব্যর্থ হওয়া যাবে না বা মানুষোচিত এক মুহূর্ত থমকে যাওয়া যাবে না। তাহলেই কিন্তু তোমার বদনাম হবে! আসল উদ্দেশ্য হল "আমি তোমায় দেব, আর তোমার থেকে হাজার গুণ বেশি আমি লুটে নেব।" 

ঠিক এই কারণেই লিয়োনেল মেসির বাঁ-পায়ের ইনসিওরেন্স ৯০০ মিলিয়ন ইউরো। কোনো ম্যাচে ৯০ মিনিটের থেকে এক মিনিট তার কম খেলা চলবে না। তার এক সেকেন্ডের উপস্থিতি কোটি কোটি টাকা রেভিনিউ জেনারেট করবে। আর 'মেসি ম্যাজিক' হলে তো কথাই নেই! এ জন্যই তাকে আর্জেন্টিনার হয়ে কাপ জিততেই হবে। নাহলে যে সে 'সর্বকালের সেরা' নয়। আর 'সর্বকালের সেরা' না হওয়া মানে তুমি ব্যর্থ। "তোমার মনখারাপ তুমি তোমার কাছে রাখো, আই নো বিজনেস, বিজনেস অ্যান্ড অনলি বিজনেস।" এ কারণেই বাইলসকে ফ্লোরে নামতেই হবে। 

বাইলস নিজে জানেন কিনা জানি না, আসলে তিনি একটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছেন। "আমি মানুষ, আমার মন না হলে আমি ফ্লোরে নামব না, ছেঁড়ার হলে তুমি ছিঁড়ে নাও", বিনয়ের সঙ্গেই ভঙ্গিটা যেন অনেকটা এরকম। এটা তাদের বিজনেসের পক্ষে বিপজ্জনক।

একসময় সেই চাপ নিতে না পেরে অবসাদ থেকে গ্রেট চ্যাম্পিয়ন মাইকেল ফেল্পস আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। এদিকে বেন স্টোকসও মেন্টাল হেলথ কনসার্নের জন্য আপাতত ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন। আওয়াজ তুলে দিয়েছেন 'মি টু'। ফাঁপরে পড়েছে কর্পোরেট জগৎ। এ যদি চলতে থাকে, তাহলে তারাও জানে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়ে যাবে। তারা কেন পরিস্থিতিকে হাতের বাইরে চলে যেতে দেবে? তারা তো চে গেভারাকেও পণ্য ক'রে তোলার সাহস দেখিয়েছে। অতএব তাদের যেন 'ভয়' পাওয়ার কিছুই নেই! ভাবখানা এতটাই বেপরোয়া। তাই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তাকেও তারা প্রোমোট করার চেষ্টা করছে। যদিও ব্যাপারটা খুদকুঁড়ো কুড়োনোর মতো। তারাও জানে এটা দুধের স্বাদ ঘোল বা ঘোলতর কিছু দিয়ে মেটানোর মতো। তবুও তারা ছাড়ার বান্দা নয়। মানসিক অসুস্থতা নিয়েও তারা বাজার করবে। মনে পড়ে যাচ্ছে '৬৮ সালে ফ্রান্সের দুনিয়াকাঁপানো স্টুডেন্ট মুভমেন্টের ঘোষণা। তারা সেদিন চিৎকার করে বলতে চেয়েছিল, "পাগল আমরা নই, পাগল তোমরা পুঁজিবাদী আর তাদের দালাল রাজনীতিকরা, পাগল তোমাদের এই ব্যবস্থা, যারা দুনিয়াটাকে পাগলাগারদ বানাতে চাইছ। আর সেই পাগলাগারদের ওপর করে খেতেও তোমাদের লজ্জা লাগছে না।" অমানুষিক চাপ তৈরি করবে তারা, দিয়ে সেই চাপে মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্পোর্টস সাইকোলজি নিয়ে ডিসিপ্লিনও খুলবে তারা, স্পোর্টস সাইকোলজিস্ট নিয়োগ করতে কোটি কোটি টাকা ঢালতে উৎসাহও দেবে তারা। 

সিমোন বাইলসের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছিলাম। কারণ ভেতরটা যেন বলে উঠতে চাইছে, "আমরা পরিশ্রম করব। কিন্তু তোমাদের দেখানো পথে পরিশ্রম করতে ভালো লাগছে না। তোমরা আমাদের প্রতিটা ঘামের বিন্দু, রক্তের বিন্দু, চোখের জলের ফোঁটা চুষে নিয়ে মুনাফা করতে চাইছ, যা আমাদের ভাল্লাগছে না। আমরা 'না' বলছি।" প্যান্ডোরার বাক্স শেষমেশ খুলবে নাকি খুলবে না সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু একবার ভাবুন তো, সেই মেহনতি শ্রমিকদের কথা যাদের রোজরোজ কারখানা কিংবা কারখানার বাইরে কাজের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কম মজুরিতে চুষে নেওয়া হয়। বেঘোরে প্রাণ দিতে হয় কারখানায়। তাদের তো হাত-পা-মন কোনোকিছুরই ৯০০ মিলিয়ন কেন ৯০ টাকার ইনিসিওরেন্সও নেই। তারা তো ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের মতো ক'রে 'না' বলার মতো প্রিভিলেজ অবস্থানের ধারেকাছেও থাকে না। উলটে আমাদের দেশে আসতে চলেছে দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজের ফরমান। আর তারা যাতে বলতে না পারে তার জন্য তাদের 'ইউনিয়ন' করার অধিকারও আইন করে কেড়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে। আমরা সিমোন বাইলস কিংবা বেন স্টোকসের 'না' বলাটাকে যত সহজে নিতে পারি, তারা কি এই শ্রমিকদের মালিকদের বিরুদ্ধে 'না' বলাকে অত সহজে নিতে পারি? শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো ধর্মঘট ডাকলে আমাদের আঙুল তো উঠে যায় সেই তাদেরই দিকে। অথচ পুঁজিবাদী দুনিয়ার চুষে নেওয়ার নীতি তো এখানেও প্রযোজ্য। উলটে বাইলসরা যে সম্মান পায়, এখানে ওয়ার্কারদের তো সেটাও নেই। 

আসলে এটাই সেই আঁধারের দিক। ওরা কখনোই চায় না খেলাকে ধরে আমাদের বিভিন্ন বোধ উপলব্ধি অনুভূতি উন্নততর বৃহত্তর জীবনবোধে উন্নীত হোক। সবকিছুকে নিয়ে ব্যবসা করা যায়, কিন্তু এটাকে নিয়ে করা যায় না। কারণ এটাকে ইন্ধন জোগালে একদিন আসবে যখন আর বিজনেসটাও করা যাবে না। তারা সবসময় চায় আমাদের চেতনাকে খণ্ডিত করে রাখতে। চায় সিমোন বাইলস থেকে লিয়োনেল মেসিদের পেছনের আঁধার আর দুনিয়ার মজদুরদের আঁধার যাতে আমাদের চেতনায় বিচ্ছিন্ন হয়েই থাকে। 

সে কারণেই তারা হাইজাম্পার ইতালিয়ান টামবেরি আর কাতারের বারশিমের প্রতিযোগিতা ভুলে দেশ-কাল-সীমানার যাবতীয় গণ্ডি নাকচ করে সোনাদানার কৃত্রিমতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে অমন মিলে যাওয়ার সহজাত মুহূর্ত নিয়েও মুনাফা করতে ভয় পায় না। কারণ আমরা যে ঐ আলো খুঁজছি। ফলে আমাদের ঠিক ঠিক আলো দেখানোর দায়ও যেন তারাই নিয়েছে। আলো কতটুকু দেখবো সেটাও তারা যেন ঠিক করে দেবে। রিফিউজিদের তারা অলিম্পিকসে স্থান দেবে। আমাদের ভালো লাগবে। কিন্তু যখনই সেই ভালো লাগা সত্তাটাই উদ্বুদ্ধ হয়ে বলে উঠবে, কেন রিফিউজি তৈরি হবে, কেন মানুষকে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধে উৎখাত হতে হবে, ইউস্রা মার্দিনিকে প্রাণের দায়ে অতটা পথ সাঁতার কেটে যেতে হবে, ইউস্রা মার্দিনির মতো লাখো লাখো শিশুদের তাহলে কি হবে, কেন মানুষকে উচ্ছেদ করার নীতি এনআরসি-সিএএ নামানো হবে... তখনই আমাদের বলা হবে "তোমরা রাজনীতি করছ। খেলার জিনিদ খেলাতেই রাখো।" অর্থাৎ টামবেরি-বারশিমকে নিয়েও খবর করে তারা ব্যবসা করবে, ইউস্রা মার্দিনিকে পোস্টার গার্ল করবে, আর একইসঙ্গে দুনিয়াজুড়ে মানুষকে বিভিন্ন পরিচয়ে বিভক্ত করে উৎখাত করে রিফিউজি-ইকোনমি দিয়ে মুনাফাও তারাই করবে। রিফিউজি ইকোনমি কী জিনিস? এই যে তাদের বন্ধুবর গৌতম আদানির দালাল নরেন্দ্র মোদী রিফিউজি বিরোধী সেন্টিমেন্টকে দেশজুড়ে ইন্ধন জোগাবে আর ওদিকে আদানিবাবু বাংলাদেশে রোহিঙ্গা রিফিউজিদের জন্য তাঁবুর টেন্ডারে বিড করে তাঁবু ব্যবসা করবেন। 

ঠিক এই কারণেই একদিকে এলজিবিটি কমিউনিটির কিছু মানুষের এবারের অলিম্পিকে অংশগ্রহণকে বড় করে দেখানো হবে, আর এই অলিম্পিকসেই আমেরিকার কালো লেসবিয়ান মেয়ে অ্যাথলিট র্যাগভেন স্যান্ডার্স শট-পাটে রুপো পাওয়ার সময় পোডিয়ামে উঠে সমস্ত শোষিত মানুষ এক জায়গায় আসার আহ্বানসূচক দু'হাত দিয়ে X চিহ্ন প্রদর্শন করলে তাকে নিয়ে অলিম্পিক কমিটি ইনভেস্টিগেশন বসাবে। কারণ সে 'রাজনীতি' করছে! আর ব্রিটেনের ডাইভার এবং গে টম ড্যালেকে তারা প্রোটেক্ট করার কথা বলবে। এই প্রোটেকশন হল তাদের বেঁধে দেওয়া ছকে প্রোটেকশন। সেই প্রোটেকশনের ছকের বাইরে বেরিয়ে র্যারভেন স্যান্ডার্স ঐসব সমস্ত শোষিতের হয়ে আওয়াজ তুললেই বিপদ। 

এই আঁধারটাই ওদের জগৎ। ওদের কাছে আলো। খেলোয়াড়রা হল ওদের কাছে অনেকটা রেভিনিউ জেনারেটিং মেশিন। যা যান্ত্রিক, অযান্ত্রিক মানবসত্তা নয়। সে কারণেই তাদের দুশ্চিন্তা উপেক্ষা করেই আইপিএল নিয়ে চলে যাওয়া হয় দুবাইতে। সে কারণেই করোনার বাড়বাড়ন্তের মধ্যেই ব্রাজিলে খেলোয়াড়দের কনসার্ন উপেক্ষা করে কোপা আমেরিকা করা হয়। সে কারণেই কাতারে প্রায় ৭ হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের হত্যার ওপর দাঁড়িয়ে ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজন করতে তাদের বাধে না। টোকিও অলিম্পিকে উচ্ছেদের গল্প তাই মিডিয়ায় ছাপা হয় না। আর তারা এসবের পক্ষে যুক্তি দেয় ‘ দ্য শো মাস্ট গো অন’। আমরাও কেমন যেন বুঝে যাই! আমরা বুঝে নিতে চাই ‘দ্য বিউটিফুল শো মাস্ট গো অন’। তারা এটা বোঝাতে চায় যে তারাও এভাবে ভাবছে। আসলে তারা নিজেরা ভাবে ‘দ্য প্রফিট মেকিং শো মাস্ট গো অন’। খেলোয়াড়রা আর আমরা দর্শকরা সেখানে যেন বাঁধা গরুর মতো!

কিন্তু বেঁধে দিতে চাইলেই কি বেঁধে দেওয়া যায়? এই কবরখানা থেকেই টামবেরি বারশিমরা বারে বারে বেরিয়ে আসবে। যেভাবে বেরিয়ে এসেছে বারবার। শুধু টামবেরি বারশিম বলে নয়। ভালো করে অলিম্পিকের বিভিন্ন ইভেন্ট খেয়াল করলেই দেখা যাবে, খেলা শেষে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণকারীদের ভেতর ধর্ম বর্ণ ইত্যাদি বিভিন্ন কিছু ভুলে একে অপরকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে চলার দৃশ্য। এই বোধটাই বোধ হয় সেখানে বেশি করে কাজ করে— আমরা সকলে অ্যাথলিট, চার বছর ধরে দিনরাত এক করে আমরা পরিশ্রম করি, আমরা জানি তিলে তিলে নিজেদের সেই গড়ে তোলার মানে, আমরা জানি যন্ত্রণা, বিরহ, অপেক্ষা, বার বার পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ানো, একে অপরকে সাহায্য করা ইত্যাদি মিলেমিশে সৌন্দর্য নির্মাণ করে, খেলতে খেলতেই প্রকৃতির বিভিন্ন নিয়মের সৌন্দর্য আমাদের কাছে ধরা পড়ে, আমরা সেই সৌন্দর্যের পূজারী। দেশ-কাল-জাতীয়তা-পদক-প্রতিযোগিতার গণ্ডি সেখানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। বারে বারে তাদের মনে আর যারা তাদের খেলতে দেখছে তাদেরও মনে ঝলক দিয়ে যায় "আমরা সবাই একটাই পৃথিবীর মুক্ত বাসিন্দা যাদের ওপরে নীল আকাশ আর নীচে মাটি ছাড়া কোনো গণ্ডি নেই"-- এই চেতনা। শত পাঁকে ডুবে থাকা মানুষও মুগ্ধ হয়ে গোগ্রাসে গিলবে এই মুহূর্তগুলো। একবার নয়, বার বার। কারণ এর মধ্যেই তার সেই ঝলক আছে, যে মানুষটাকে সে স্বপ্নের পৃথিবীতে দেখতে চায়। আর বারবার হাজারো বাঁধন ছিঁড়ে সেই স্বপ্নটাকেই আরেকবার করে চাগাড় দিয়ে যাবে। এরিকসনের জন্য গ্যালারিতে থাকা ফিনল্যান্ড আর ডেনমার্কের মানুষরা কিছুক্ষণের জন্য হলেও কী করে যেন সেই একটা মুক্ত পৃথিবীর সৃষ্টিশীল দলবদ্ধতার পরিচয় দিয়ে ফেলবে! 

কিন্তু এটুকুতেই শেষ নয়। কারণ তাহলে তো কেউ প্রশ্ন করতেই পারে, একজন খেলোয়াড়ের যদি এত কিছু মনে হয় তাহলে সচিন তেন্ডুলকর ‘অ্যামিকবল সলিউশন’-এর পক্ষে গা ভাসিয়ে দেন কীভাবে কিংবা মেরি কমই বা এনআরসি-র সমর্থন করে দেন কীভাবে। কারণ তারাও সেই সমাজব্যবস্থার অংশ যে সমাজব্যবস্থায় আমরাও রয়েছি। তারা মঙ্গলগ্রহ থেকে আসেননি। ফলে খণ্ড চেতনার জন্য আমরা যেভাবে খেলা থেকে উঠে আসা জীবনবোধকে বৃহত্তর জীবনবোধে মেশাতে পারি না, সব কেমন আলাদা আলাদা হয়ে থাকে, তেমনি সচিন মেরিদের ক্ষেত্রেও তাই। সেই খণ্ড চেতনার কারণেই হয়তো এত কোণঠাসা অবস্থার পরেও শ্রমিকদের এক হয়ে এই মুনাফাখোর ব্যবস্থাটাকে বদলে দিতে দেখা যাচ্ছে না। উলটে কখনো কখনো দাঙ্গা করে বসছেন নিজেদের ভেতর। 

আসলে লড়াইটা এখানেই। আমাদের খণ্ডচেতনাকে ইন্টিগ্রেট করার। শুধু খেলাধূলা নয়, যেখানে জীবনবোধের যা উপাদান আছে, সেগুলোকে জড়ো করে বৃহত্তর জীবনবোধের আকাঙ্ক্ষায় বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। ওরা সবসময় চাইবে আমাদের শুভ ইচ্ছাগুলোকে ব্যবহার করে নিয়ে ব্যবসা করার। চাইবে টাকার অঙ্কে সবকিছুকে মেপে নিতে। সেই মূল্যবোধই শেখাবে তারা। কিন্তু ল্যাঙ খেতে খেতে না-পাওয়া জীবনে যাবতীয় সৃষ্টিশীলতা থেকে বিচ্যুত হয়ে আমাদের কেবল খেলাধূলার কনজিউমার হয়ে থাকলে আর চলবে না। কনজিউমার হতে হতে লটারির বিকল্প ড্রিম ইলেভেন বা এম.পি.এল-এর ফ্যান্টাসি লিগে ডুব দিয়ে খেলোয়াড়দের ভগবান বা শয়তান হিসেবে নির্মাণ করার সংস্কৃতিতে ভুলে গেলে চলবে না। 

আমাদের প্রশ্ন করতো হবে ক্রীড়ানীতি নিয়ে। আমাদের বলতে হবে "তুমি টামবেরি আর বারশিম নিয়ে খবর করার সঙ্গে সঙ্গে কী করে 'পাকিস্তান ভারতের থেকে হকিতে পিছিয়ে যাচ্ছে' মার্কা খবর করে কাঁটাতারকে উস্কে দাও", আমাদের বলতে হবে  রিফিউজিদের অংশগ্রহণ করানো আর উচ্ছেদ করে অলিম্পিক আয়োজন করা-- একসঙ্গে কীভাবে হতে পারে, কীভাবে একজন লেসবিয়ানের অলিম্পিকে অংশগ্রহণকে ফলাও করার সঙ্গে সঙ্গেই তার মতামতকে দমিয়ে দেওয়ার পলিসি নাও। বলতে হবে, আমরা খেলা ভালোবাসি তাই তোমাদের এই শুষে নিয়ে মুনাফা করার আদর্শে ক্রীড়াবিশ্বের (অতএব বিশ্বের) যে ক্ষতি হচ্ছে, তা আমরা চাই না; আমরা চাই এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে পরিশ্রম করা খেলোয়াড় থেকে শ্রমিক-- সকলের সম্মান থাকবে; সকলে মুক্ত থাকবে, থাকবে না কোনো অমানুষিক চাপ। চলবে না তোমাদের ছকে এই দুনিয়াকে বেঁধে দেওয়া। 

নেলসন ম্যান্ডেলা একবার বলেছিলেন, "খেলাধূলার ক্ষমতা আছে পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার"। উনি কী ভেবে আর কোন জায়গা থেকে এটা বলেছিলেন জানা নেই, কিন্তু নিশ্চিতভাবে পৃথিবী বদলে দেওয়ার উপাদান খেলাধূলার ভেতর রয়েছে। তাই তো আজও খেলাধূলাকে কেন্দ্র করেই সবচেয়ে বেশি করে মুক্ত দুনিয়া এবং সুন্দর মানুষের ঝলক বারবার ভেসে ওঠে। আর তাই খেলাধূলাকেই ওরা সবচেয়ে বেশি করে বেঁধে রাখতে চায়। খেলাধূলা থেকে জাত জীবনবোধকে খণ্ডিত করে রাখার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যায়। 

এই আঁধারটাকে আমাদের সকলে মিলে চিনতেই হবে। তবেই সেই স্বতঃস্ফূর্ত ভালো লাগার আলোর ঝলকগুলো আরো অবাধে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। তবেই আমাদের খণ্ডচেতনা ইন্টিগ্রেট করার সুযোগ পাবে। পৃথিবী হয়তো অনেক সুন্দর হয়ে উঠবে৷

Powered by Froala Editor

Latest News See More