শিক্ষার্থীদের মনোসংযোগের জন্য দেশজুড়ে পালিত হয় নীরবতা

বন্ধ শহরের সমস্ত দোকান-পাট। স্কুল, কলেজ, অফিস, কারখানাও বন্ধ। থমকে রয়েছে বৌদ্ধ মনেস্ট্রির ঘণ্টা। রাস্তায় যানবাহন নেই কোনো। শহরজুড়ে পিন পড়া নিস্তব্ধতা। ব্যাপার কী? তবে কি আবার মহামারী হানা দিল এ-শহরে? নাকি বিশেষ কোনো কারণে শোকপালন চলছে শহরজুড়ে? 

নভেম্বর মাসে দক্ষিণ কোরিয়ায় (South Korea) গেলে এমনই আশ্চর্য এক দৃশ্যের সাক্ষী হবেন আপনি। প্রতি বছর নভেম্বর মাসের একটা গোটা দিন দেশজুড়ে পালিত নীরবতা দিবস উপলক্ষে। সকাল ৮টা থেকে সন্ধে পর্যন্ত বন্ধ থেকে সমস্ত দৈনন্দিনের কার্যকলাপ। তবে কোনো শোকপালন নয়, দেশের শিক্ষার্থীরা যাতে সম্পূর্ণভাবে মনোসংযোগ করতে পারেন পরীক্ষার খাতায়, তার জন্যই এই বিশেষ বন্দোবস্ত। 

কলেজ স্কলাস্টিক এবিলিটি টেস্ট। স্থানীয়দের কাছে এই পরীক্ষা পরিচিত ‘সানেয়াং’ (Suneung) নামে। ভারতের ইউপিএসসি-র সঙ্গে বিশ্বের কঠিনতম পরীক্ষাগুলির তালিকায় প্রথম দশের মধ্যেই রয়েছে এই পরীক্ষাটিও। দু’-এক ঘণ্টা নয়, ৮ ঘণ্টা ধরে চলে এই পরীক্ষা। কলেজ উত্তীর্ণ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে কিনা তা ঠিক করে দেয় সানেয়াং। পাশাপাশি পরবর্তীতে কোন শিক্ষার্থীর উপার্জন কত হবে, ভবিষ্যতে তারা কোথায় চাকরি পাবে, কোথায় থাকার সুযোগ পাবে— এসবও নির্ধারণ করে সানেয়াং। এক কথায় বলতে গেলে, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিটি নাগরিকের ভাগ্যই নির্ভর করে এই পরীক্ষার ওপর। 

কাজেই বাড়তি করে বলার প্রয়োজন থাকে না এই পরীক্ষার গুরুত্ব ঠিক কতটা। শিক্ষার্থীরা তো বটেই, দেশের প্রশাসনও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করে বিষয়টা। আর সেই কারণেই এই নীরবতা পালনের প্রথা সে-দেশে। এমনকি পরীক্ষার জন্য এইদিন বন্ধ থাকে দেশের সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণও। শিক্ষাক্ষেত্রে ন্যূনতম জালিয়াতি কিংবা প্রশ্নপত্র যাতে প্রকাশ্যে না আসে, সেই বিষয়টিও মাথায় রাখে প্রশাসন। এমনকি দেশের তৈরির জন্য নিযুক্ত করা হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৫০০ জন শিক্ষককে। পরীক্ষার এক মাস আগেই গ্র্যাংওয়ান প্রদেশের পাহাড়ের একটি গোপন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই দিন গুজরান করেন তাঁরা। 

পরীক্ষার দিন ভোর থেকেই শুরু হয়ে যায় তোড়জোড়। দেশের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিশেষ পরিবহনের ব্যবস্থা করে সরকার। কখনও আবার খোদ পুলিশকর্মীরাই বাইকে করে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দেন শিক্ষার্থীদের। উপচে ওঠে দেশের বৌদ্ধ মনেস্ট্রি, মঠ এবং মন্দিরগুলি। সন্তানের মঙ্গলকামনার জন্য সেখানে হাজির হন হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের জন্য খাবার-দাবারেরও আয়োজন করা হয় সেখানেই। 

প্রতিবছর সবমিলিয়ে এই পরীক্ষা দেয় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় ৫ লক্ষ শিক্ষার্থী। যার মধ্যে পাশ করানো হয় মাত্র ২০ শতাংশকে। বাকি ৮০ শতাংশের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নির্ভর করে অর্জিত নম্বরের ওপর। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, কঠিনতম এই পরীক্ষায় পাশ করা মানেই যে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যায় দক্ষিণ কোরিয়ার পড়ুয়ারা, তেমনটা নয়। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকা শিক্ষার্থীদের এক-তৃতীয়াংশই বেকার দক্ষিণ কোরিয়ায়। শিক্ষার হারের দিক থেকে দক্ষিণ কোরিয়া এগিয়ে থাকার কারণেই এই সমস্যা। আসলে, ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের ‘সানেয়াং’-এ পাশ করানো হলেও, সেই অনুপাতে ব্লু-কলার কর্মসংস্থানের পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি দক্ষিণ কোরিয়া। প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সংঘাত তার একটি কারণ। পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার সমস্ত যুবকদেরই সামিল হতে হয় সেনাবাহিনীতে। ফলে সেনাবাহিনী থেকে ফেরার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও অনেকেরই আর ফেরা হয়ে ওঠে না পড়াশোনার জগতে। অন্যদিকে মনের মতো চাকরি জোগাড় করাও কঠিন হয়ে ওঠে তাঁদের পক্ষে। সবমিলিয়ে এই ঘটনা রীতিমতো ছাপ ফেলে বহু শিক্ষার্থীদের মানসিকতায়। হতাশার শিকার হওয়ায় যুবসমাজে আত্মহত্যার হারও ঊর্ধ্বগামী দক্ষিণ কোরিয়ায়। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতিমধ্যেই লড়াই চালাচ্ছে প্রশাসন। আনা হয়েছে একাধিক প্রকল্প। তবে এও স্পষ্ট, যে একদিনে পরিবর্তন আসবে না কোনোভাবেই… 

Powered by Froala Editor