হাজার হাজার দর্শনার্থীদের মতো রেনেসাঁর বিখ্যাত শিল্পীদের ছবি দেখতে তিনিও হাজির হয়েছিলেন ফ্লোরেন্সের উফিজি গ্যালারিতে। এতটুকু ভাঁটা ছিল না উত্তেজনায়। কিন্তু গ্যালারিতে পা দেওয়ার পর থেকেই ক্রমশ একটু একটু করে শরীর খারাপ করতে থাকে তাঁর। তবে তিনি নিজেও চিন্তা করেননি কী ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করে রয়েছে তাঁর জন্য। বত্তিচেল্লির আঁকা ‘দ্য বার্থ অফ ভিনাস’ ছবিটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বুক হাত চেপে বসে পড়লেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যেই হারালেন জ্ঞান। গ্যালারি কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো হয়েছিল তাঁকে। তবে আর কিছুক্ষণের দেরি হলেই প্রাণসংশয় হত তাঁর। আদতে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনারি অ্যাটাকে।
না, কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি নন তিনি। ২০১৮ সালের এই ঘটনার উল্লেখ করার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আসলে সেবার কোনো সাধারণ কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হননি ওই ব্যক্তি। বরং, তাঁর এই আকস্মিক অসুস্থতার পিছনে দায়ী ছিল গ্যালারিতে প্রদর্শিত ঐতিহাসিক চিত্রগুলি। অবাক লাগলেও এমনটাই সত্যি! মন্ত্রমুগ্ধকর দৃশ্য কিংবা শিল্পও কখনও কখনও অসুস্থতার কারণ হয়ে ওঠে মানুষের। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই বিশেষ রোগটির নাম স্টেনডাল সিনড্রোম।
শুরু গল্পটির মতোই, স্টেনডাল সিনড্রোমের সূত্রপাতের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে ফ্লোরেন্স নগরী। ১৮১৭ সাল সেতা। রোম, ন্যাপলস এবং ফ্লোরেন্স— এই তিন ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী শহরে ঘুরতে গিয়েছিলেন ফরাসি লেখক ও ভ্রমণকারী মারি-হেনরি বেইল। ‘স্টেনডেল’ মূলত তাঁরই ছদ্মনাম। শিল্পজগতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও, সম্ভবত তিনিই ছিলেন এই অদ্ভুত রোগের প্রথম শিকার। অন্তত, সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা প্রথম নথিবদ্ধ করেন তিনিই।
ব্যাসিলিকা ডি সান্তা ক্রোসে গিয়েই প্রথম এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন বেইল। রেনেসাঁর শিল্পী এবং ইতালির ইতিহাস নিয়ে সর্বদাই কৌতূহল ছিল তাঁর। আর ব্যাসিলিকা ডি সান্তায় সমাহিত রয়েছেন রেনেসাঁ যুগেরই কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বরা। কাজেই এই গির্জাভ্রমণ নিয়ে আগ্রহের শেষ ছিল না তাঁর। কিন্তু মিকেলঅ্যাঞ্জেলো, ম্যাকিয়াভেলি এবং গ্যালিলিও— পাশাপাশি শায়িত এই তিন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বের সমাধির সামনে গিয়েই হঠাৎ করেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন বেইল। জমাট বাঁধতে শুরু করে মনখারাপ। সেখান থেকে দানা বাঁধতে শুরু করে ভয়।
আরও পড়ুন
জলবায়ু পরিবর্তনের জের, মুছে যাচ্ছে প্রাচীন গুহাচিত্র
নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতেই ওই অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন চার্চের নিঃস্তব্ধ পরিবেশ হয় শান্তি এনে দেবে তাঁকে। কিন্তু ব্যাসিলিকায় প্রবেশের পর ভল্টেরানোর ফ্রেস্কো দেখেই হঠাৎ যন্ত্রণা শুরু হয় তাঁর বুকে। চার্চ থেকে বেরিয়ে আসার পরই রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন বেইল।
আরও পড়ুন
আজ বিদ্রোহের জন্মদিন
নিজের এই অভিজ্ঞতার কথা ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করার সময় বেইল উল্লেখ করেছিলেন তাঁর সন্দেহের কথা। এই চরম সুন্দর কোনো শিল্প কিংবা স্থাপত্য দেখার উত্তেজনা এবং আনন্দই এই হঠাৎ অসুস্থতার কারণ। কিন্তু তৎকালীন চিকিৎসাবিজ্ঞান কোনোরকমই গুরুত্ব দেয়নি তাঁর এই সন্দেহকে।
প্রায় দেড় শতক পেরিয়ে এসে, বিশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে ফরাসি লেখিকার এই সন্দেহকেই স্বীকৃতি দেন মনোবিজ্ঞানীরা। ১৯৭৯ সালে ফ্লোরেন্সের সান্তা মারিয়া নুভা হাসপাতালের মনোবিজ্ঞানী তথা গবেষক গ্রাজিয়েলা ম্যাগেরিনি এই রোগের বিশ্লেষণ করেন। জানান, শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে হৃদরোগ, হ্যালুসিনেশন— সবকিছুই এই রোগের লক্ষণ হতে পারে। ‘স্টেনডাল সিনড্রোম’ কথাটিও প্রথম ব্যবহার করেন তিনিই।
১৯৭৯ সালের পর আজ পর্যন্ত স্টেনডাল সিনড্রোমের প্রায় শতাধিক ঘটনা রেকর্ড করেছেন গবেষকরা। এবং আশ্চর্যজনকভাবেই অধিকাংশ ঘটনার প্রেক্ষাপটই ইতালি। বিশেষত ফ্লোরেন্স। মনোবিদদের মতে, ফ্লোরেন্স শিল্প ও সংস্কৃতির পীঠস্থান হওয়ায়, বার বার এই ধরনের ঘটনার দেখা মেলে সেখানে। সৌন্দর্যও যে কখনও কখনও ঘাতকের রূপ নেয়, তারই প্রমাণ এই অদ্ভুত রোগ…
Powered by Froala Editor