শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কথামৃত

আজ কথাসাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। অষ্টআশি পূর্ণ করলেন তিনি। জীবনের বিভিন্ন টুকরো-টুকরো ঘটনা, যা খোদ তাঁর মুখ থেকেই শোনা, সংকলিত করলেন সমীর চট্টোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জবানিতেই এগিয়েছে লেখাটি।


অপমান আর প্রত্যাখ্যানের কড়া রোদ যত পিঠ পুড়িয়ে দিত ততই জেদ বাড়ত। জেদ বাড়লেই লেখা ভালো হত। আমার তো কোনো পৃষ্ঠপোষক নেই। না পরিবার না কোনো ক্ষমতাশালী সম্পাদকের প্রশ্রয় না কোনো পেটোয়া প্রকাশক, যিনি যা খুশি লিখি না কেন বই করে ছেপে দেবেন। আমি জানতাম লিখে আমাকে এইসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হবে। আমি লিখতে পারি। অনেকের তুলনায় অন্য রকম লিখতে পারি। লিখে সবার মুখের ওপর জবাব দেব। তাই আমাকে হরেক রকমের লেখা হরেক পত্র-পত্রিকায় লিখতে হয়েছে। কোনও ছুঁৎমার্গ রাখিনি। কবে কোন বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিকের মাননীয় সম্পাদক লিখতে বলবেন তার জন্য কলমের কালি শুকিয়ে রাখিনি। তাই হয়তো অনেক লিখতে হয়েছে। লিখতে লিখতে পিঠ বেঁকে গেছে। সব লেখা হয়তো সমান উতরোয়নি। অর্থনৈতিক পারিপার্শ্বিক আর একটু থিতু হওয়ার সুযোগ পেলে হয়তো লেখাগুলো আরও ইমপ্রুভড হত।    

আমার বন্ধুরা বড়ো ক্লাবের জার্সি পড়ে স্বনামধন্য কোচের নির্দেশে মাঠে খেলবে আর আমি সাইডলাইনের পাশে বসে দেখব, এ অপমান সহ্য করতে পারিনি। তাই জার্সি যাই হোক না কেন, মাঠ যেমন তেমন হোক, আমি খেলা বন্ধ রাখিনি। অনামী ছোট স্কুলের ভালো ছাত্রের ভালো রেজাল্ট যেমন লোকের চোখে পড়ে না, আমার লেখাগুলোর ভাগ্যেও তাই জুটেছে। ভালো পাঠকের চোখ এড়িয়ে গেছে। আমি দমিনি। মেনে নিয়েছি এই আমার ভবিতব্য। সময় লাগবে। তবে এও জানি, সময়ের জিনিস সময়ে না হলে তার আর তেমন স্বাদ থাকে না। 

আমার ঠিক ওপরের ভাই তনুদা। দেশভাগের পর দত্তপুকুরে কয়েক মাস কাটিয়ে আমরা গুষ্টিসুদ্ধ সবাই টালিগঞ্জ ফাঁড়ির ওই বাড়িটায় যেখানে এখন আমার ছোটভাই তাপস থাকে চলে আসি। তনুদা আশুতোষ কলেজে। বি এস সি দেবে। একমাথা কালো কোঁকড়া চুল। লম্বা চওড়া ফর্সা। গম্ভীর। সামনেই টেস্ট। সারাদিন পড়ে। মোটা মোটা কেমিস্ট্রির বই। একপাশে টলস্টয়ের আনা কারেনিনা। একদিন সন্ধ্যায় বেরিয়ে আর ফিরল না। মেজদা বড়দা থানায় গেল। কোনো খবর নেই। পরদিন অজ্ঞাত পরিচয় যুবকের মৃতদেহ পাওয়া গেল লেকের পাড়ে। তনুদার ডেডবডি। সুইসাইড। পটাসিয়াম সায়ানাইড। আজও আমরা কারণ জানি না। মৃত্যুর সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। তনুদার সুবাদে কেওড়াতলার সঙ্গেও প্রথম পরিচয়। মা আধপাগল। বাবার চোখের মণি অস্থির ধোঁয়াটে। মেজদা একদম গম্ভীর। বড়দা চুপ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মৃত্যু আমাকে সারা জীবন তাড়া করে বেরিয়েছে। মৃত্যু সম্পর্কে আমাকে নিস্পৃহ উদাসীন করে দিয়েছে। আমার অনেক লেখায় এই মৃত্যুর ছায়া আছে। 

আরও পড়ুন
বন্ধুর অহংকার ভাঙাতেই প্রথম কবিতা লেখেন শিবনাথ শাস্ত্রী

একসময় প্রতিটা পুলিশ ব্যারাকে কুস্তির আখড়া ছিল। আমি ভর্তি হলাম। তেল মেখে শেষরাতে বুকডন বৈঠক। মাটি মেখে কুস্তি। আড়াই প্যাচ, রদ্দা সদ্দা গদ্দা, দম ধরে রাখা। কুস্তির শেষে ওস্তাদকে পিঠে নিয়ে সারা আখড়া আড়াইবার পাক দিতে হয়। এতে কোমরের জোর বাড়ে। এই কোমরের জোর, দম ধরে রাখা পরে লেখার জগতে এসে কাজ দিয়েছে। অপমান প্রত্যাখ্যান আমাকে অনন্ত সময় পেড়ে ফেলে রাখতে পারেনি। আজও সেই জোর পাই। ইস্পাত কারখানায় প্রায় তিন বছর গলন্ত ইস্পাতের সামনে আগাগোড়া দাঁড়িয়ে ডিউটি দেওয়ায় বাসে বা কোথাও দাঁড়াতে কষ্ট হয় না। দাঁড়ালে বরং ভালোই লাগে। খবরের কাগজে বহু বছর নাইট ডিউটি দেওয়ায় এখনও মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে উঠে বসে দিনের মতোই পড়ি লিখি হাঁটি খাই। রাত দুটোকে মনে হয় বেলা দুটো। কোনো জিনিসই সহজে হয় না বলে চারদিক থেকে আমার গলা টিপে ধরলেও আমি চমৎকার খেলতে পারি। দিব্যি কাটিয়ে বেরিয়ে আসি। অভ্যস্ত হয়ে গেছি। 

আরও পড়ুন
দু-বোতল মহুয়া খেয়ে ‘অবনী বাড়ি আছো’ লিখলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়

অল্প বয়সে একটি নামী সাপ্তাহিকে ধারাবাহিক লেখার সুযোগ পাই। লিখলাম উপন্যাস বিষয় আশয় নিয়ে। সম্পাদক বিজ্ঞাপন দিতেন 'ধারাবাহিক রচনা'। লেখা যখন জমে উঠেছে সম্পাদক বললেন, আগামী তিন চার কিস্তিতে শেষ করো। আমি বললাম, সে কী করে সম্ভব। সম্পাদকের হুকুম বলে কথা। শেষ করতে বাধ্য হলাম। সেই সম্পাদক বারো বছর পর সেদিন বললেন, কী বই লিখেছিলে শ্যামল। ক্লাসিক। আমি ধন্য হয়ে কৃতার্থের হাসি হেসে ছিলাম। এখন সেই ডার্টি অপ্রমাণিত সাবজেক্টিভ, আচমকা শেষ করে দেওয়া বইখানি নিয়ে শুনি মাস্টারমশাইরা প্রবন্ধ লিখছেন, কেউ কেউ গবেষণা করছেন। এই আমার কপাল। 

আরও পড়ুন
সভা-সমিতিতে নয়, বিরলে বসে নিঃশব্দে পড়ার কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন নিশীথ ভড়

কত যে গল্প। এক আধটা বলি। 

‘অদ্য শেষ রজনী’ শারদীয় বেতার জগতে ছাপবে বলে আমন্ত্রণ করে তৎকালীন সম্পাদক নিয়ে লাল কালিতে কেটেকুটে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেরত দিলেন কেননা এতে সেই সময়ের একজন বিতর্কিত অভিনেতার প্রত্যক্ষ ছায়া রয়েছে। আমি আবার নতুন করে ওই ঢাউস লেখাটা লিখে মণীন্দ্র রায়কে (মণিদা, তৎকালীন অমৃত-র সম্পাদক) জমা দিলাম। মণিদার ভালো লাগল। অমৃত সাপ্তাহিকে ধারাবাহিক ছাপা হল। 

‘ঈশ্বরীতলার রূপকথা’ দুই প্রথিতযশা সম্পাদক ফেরত দিলেন গরু কুকুর বেড়াল ছাগল নিয়ে লেখা অপাঠ্য অবান্তর উপন্যাস তকমা দিয়ে। নবকল্লোলের সম্পাদক মধুসূদন মজুমদারকে পড়তে দিলাম। তিনি পড়ে আপ্লুত হয়ে ডেকে পাঠালেন। নিজের লেখা তুলে নিয়ে ওই বছরের শারদীয় সংখ্যায় আমার লেখাটি ছাপলেন। নবকল্লোলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তৈরি হল। অনেক লেখা লিখলাম। মধুদা বড়ভাইয়ের স্নেহ দিয়েছেন আমাকে। আমার দুঃসময়ের দাদা। 

‘আলো নেই’ উপন্যাস ধারাবাহিক বেরোচ্ছে। মহিলা সম্পাদক হঠাৎই বললেন, আগামী কয়েক কিস্তিতে সমাপ্ত করতে। এবার আর আগের মতো ভুল করিনি। যা কিস্তি জমা ছিল তা ছেপে “অনিবার্য কারণে এই উপন্যাস আর প্রকাশিত হবে না” বিজ্ঞাপন দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ করলাম। যা লেখার পরে ধীরেসুস্থে লিখব। 

আমার সমসময়ের আর কারোর ক্ষেত্রে এমন ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই। হ্যাঁ, মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু কলম কাগজ তুলে রাখিনি। আশাভঙ্গের সঙ্গে বারবার আমার দেখা হয়েছে কিন্তু তাকে পাত্তা দিইনি, আমল দিইনি। 

আমার দুঃসময়ে দুর্দিনে যে সম্পাদকরা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন— মণীন্দ্র রায়, মধুসূদন মজুমদার, রবি বসু, অমিতাভ চৌধুরী (শ্রী নিরপেক্ষ), সমরেশ বসু— এঁদের প্রশ্রয় না পেলে আমার লেখক অস্তিত্ব অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারত। 

কিছু গড়ে তোলার নেশা, কিছু বানানোর নেশা আমাকে আজীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। বন্ধুত্বের জন্য আমার হ্যাংলামি আমাকে তৃষ্ণার্ত করে রাখে। আমি খুলতে চেয়েছি একটা কোম্পানি— লাভ লাভ অ্যান্ড লাভ কোম্পানি। আমার তৃষ্ণা আমাকে বিষাদ উপহার দিয়েছে। এ এক অদ্ভুত খেলা। যাকে ভক্তি করি, ভালোবাসি— তার সঙ্গেই আমার সবচেয়ে আগে রাগারাগি হয়। যে কাজ খুব মন দিয়ে করি সেটাই নিন্দা কুড়োয়। যেটায় অবহেলা থাকে, তার ভাগ্যে জোটে ভূয়সী প্রশংসা। আনন্দ করব বলে সবাইকে একত্র করলাম, পরিণামে নিরানন্দ বিষাদ। এ আমি গোড়া থেকেই দেখে আসছি। গেলাম এক জায়গায়— দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার চম্পাহাটি— খোলামেলায় বাস করব বলে সেখানে গিয়ে জমির নেশায় জড়িয়ে পড়লাম—চাষবাসে। বড়ো আরও বড়ো করে চাষ করলাম। লেখা মাথায় উঠল। আসতে শুরু করল টাকা। এ আমার আরেক নিয়তি আরেক  ভবিতব্য। আমি যাতেই হাত দিই তাতেই টাকা আসে। আবার তা চলেও যায়। যেমন মাজরা পোকা বিঘের পর বিঘে ধান শুকিয়ে খড় করে দিল, তেমনই টাকাও অদৃশ্য হয়ে যায়। 

কিছুতেই লিখব না, গ্রামে আর থাকব না, ভদ্দরলোকের জীবন যাপন করব বলে ফিরে এলাম কলকাতায়। হুড়মুড় করে তখন লেখা আসতে লাগল কলমে। ভালো হব বলে এগিয়েছি, ফিরে এসেছি গোলমাল করে। শায়েস্তা করব বলে ঝাঁপ দিয়ে ফিরে এসেছি গলা জড়াজড়ি করে। জীবনটা কি একটা পেন্সিল? তার শিস ছুঁচলো করে কেটেই যাব শুধু? নাকি জীবন ঘাসের ওপর নিরুত্তাপ শুয়ে আকাশ দেখা শুধু। 

কতো স্বপ্ন নিয়ে অমৃত-র শুরু। ওপরওলার পরিকল্পনাহীনতায় বন্ধ হয়ে গেল। নব পর্যায়ের কৃত্তিবাসে বন্ধুত্বের তৃষ্ণা নিয়ে গিয়ে একরাশ বিষাদ নিয়ে ফিরে এলাম। আনন্দবাজারে যিনি হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে অভিমানে আঠারো বছরের মেলামেশা ছেড়ে চলে এলাম। তাই মনে হয় আমি কোনো নিরাসক্ত উদাসীন নিমগ্ন নদীতে ভেসে যাওয়া খড়কুটো। মনহীন উদ্দেশ্যশূন্য কার্যকারণ-বিচ্ছিন্ন অকারণ পুলকের বুদবুদ হয়ে ভাসছি তো ভাসছি। তাহলে কি বড়ো সাইজের কারও কৌতুকের হাসির ঝর্ণার কিনারায় ছিটকে যাওয়া আশ্চর্য চিহ্নমাত্র আমি?

হতে গেলাম মস্তান, হয়ে গেলাম প্রেমিক। হতে গেলাম প্রেমিক, হয়ে গেলাম নভেলিস্ট। অবশ্য আদৌ যদি হয়ে থাকি।

Powered by Froala Editor

More From Author See More