“আমার ছেলেবেলা থেকে ডায়েরী লেখার অভ্যাস ছিল। যখন যেখানে ভাল বক্তৃতা বা ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ শুনতুম, তখনই বিশেষ ভাবে লিখে রাখতুম। সেই অভ্যাসের ফলে ঠাকুরের সঙ্গে যেদিন যা কথাবার্তা হত, বার তিথি নক্ষত্র তারিখ দিয়ে লিখে রাখতুম।”
এইভাবেই লিখে গেছেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। সৃষ্টি করেছেন তার শ্রেষ্ঠকীর্তি, পাঁচ খণ্ডে রামকৃষ্ণকে নিয়ে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। ‘শ্রীম’, ‘মাস্টার’, ‘মণি’, ‘মোহিনীমোহন’ বা কখনও কেবল ‘একজন ভক্ত’ নামের আড়ালে নিজেকে লুকোতে চেষ্টা করলেও, প্রকৃত পরিচয় বাঙালি পাঠকের কাছে গোপন রাখতে সক্ষম হননি।
মহেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসেন বিয়ের বেশ কিছুদিন পর। ঘটনাটি মজার। পারিবারিক অশান্তি থেকে সাময়িক নিষ্কৃতিলাভের আশায় ভগ্নীপতির বাড়িতে এসেছিলেন মহেন্দ্রনাথ। এর আগে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও ব্রাহ্মসমাজের একজন কর্মকর্তা নগেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে প্রথম খোঁজ পান রামকৃষ্ণ। এবং এর কিছুদিন বাদেই দক্ষিণেশ্বরে তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় রামকৃষ্ণর। রামকৃষ্ণ সেদিন অবিবাহিত জীবনের প্রশংসা করছিলেন। কথার শেষে মহেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেন, “বিয়ে করেছ?” মহেন্দ্রনাথ উত্তরে হ্যাঁ বললে রামকৃষ্ণ ভাইপোকে ডেকে সবিস্ময়ে বলেন, “ওরে রামলাল, যাঃ বিয়ে করে ফেলেছে!”
সেই সাক্ষাতের পরে রামকৃষ্ণের সঙ্গে ক্রমশ তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পরেও অটুট ছিল।
আরও পড়ুন
বিকেলেও বেড়িয়ে এলেন সুস্থ শরীরে, রাতে হঠাৎ বন্ধ হৃদযন্ত্র; মৃত্যু আগাম টের পেয়েছিলেন বিবেকানন্দ?
পেশায় শিক্ষক ছিলেন মহেন্দ্রনাথ। লোকে ডাকত মাস্টারমশাই বলে। সেই দেখাদেখি রামকৃষ্ণও তাই বলতেন। ‘মাস্টার’। এমনকি রামকৃষ্ণের অনুগামী ও শিষ্যদের মধ্যেও সেই নামেই বিখ্যাত ছিলেন তিনি।
রামকৃষ্ণ মাঝেমধ্যেই বিবেকানন্দর সঙ্গে মাস্টারের তর্ক লাগিয়ে মজা দেখতেন। স্বভাব লাজুক মহেন্দ্রনাথ বিবেকানন্দর ধারালো যুক্তির সামনে চুপ করে থাকতেন, রামকৃষ্ণ মজা করে কখনও বলতেন, “পাশ করলে কি হয়, মাস্টারটার মাদীভাব, কথা কইতেই পারে না”, আবার কখনও বলতেন “ও স্কুলে দাঁত বার করবে; আর এখানে গান গাইতেই যত লজ্জা।”
আরও পড়ুন
‘দরকার হলে বেলুড় মঠের জমি বিক্রি করে দেব’, মহামারী রুখতে সংকল্প বিবেকানন্দের
যদিও বিবেকানন্দের সঙ্গে ততদিনে তার প্রগাঢ় বন্ধু স্থাপিত হয়েছে। তখন সদ্য বাবা মারা গেছেন বিবেকানন্দের। সংসারে দারিদ্র্য তীব্র হয়ে উঠেছে। এমন অবস্থায়, একদিন তার বাড়িতে উপস্থিত হলেন মহেন্দ্রনাথ। বিবেকানন্দের অনুপস্থিতিতে। তাঁকে না জানিয়ে, বিবেকানন্দের জননীর হাতে গোপনে দিয়ে গেলেন একশো টাকা। এই শর্তে, বিবেকানন্দ যেন জানতে না পারেন। কারণ তিনি জানতেন, জানলে শতকষ্টেও তা ফেরত দেবেন বিবেকানন্দ। পরবর্তীকালে তাঁরই সহযোগিতায় মেট্রোপলিটন বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদ পান বিবেকানন্দ।
রামকৃষ্ণ মারা যাওয়ার পর যুবক ভক্তগণ যখন প্রায় দিশাহীন, সহায়-সম্পদহীন, তখন সামান্য যে-ক’জন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের মধ্যে মহেন্দ্রনাথ একজন। বিবেকানন্দ তার লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, “রাখাল, ঠাকুরের দেহত্যাগের পর মনে আছে, সকলে আমাদের ত্যাগ করে দিলে - হাবাতে (গরীব ছোঁড়াগুলি) মনে করে? কেবল বলরাম, সুরেশ (সুরেন্দ্র মিত্র), মাস্টার ও চুনীবাবু - এঁরা সকলে বিপদে আমাদের বন্ধু। অতএব এঁদের ঋণ আমরা কখনও পরিশোধ করতে পারব না।”
আরও পড়ুন
‘নতুন মাস্টার পড়াতে পারেন না’, শুনে বিবেকানন্দ-কে চাকরি থেকে বরখাস্ত বিদ্যাসাগরের
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নানা বিদ্যালয়ে পড়ানোর পর ঝামাপুকুরে মর্টন ইন্স্টিটিউট কিনে নিলেন মহেন্দ্রনাথ। জীবনের শেষপর্যন্ত সেখানেই পড়িয়েছেন তিনি। অবসর সময়ে রামকৃষ্ণের জীবনকাহিনি শোনাতেন ভক্তদের। কথামৃত শোনার জন্য তার আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে দূর-দূরান্ত থেকে ভিড় জমাতেন শ্রোতারা।
রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎগুলোকে দিনলিপি হিসেবে লিখে রাখতেন মহেন্দ্রনাথ। এইসব দিনলিপি-অবলম্বনেই রামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পরে তিনি লেখেন ‘Gospel of Sri Ramakrishna’ (শ্রীরামকৃষ্ণের-উপদেশ)। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ছোটো পুস্তিকাকারে লেখাটা প্রকাশিত হলে স্বামী বিবেকানন্দ সহ অনেকেই লেখাটির প্রচুর প্রশংসা করেন এবং আরও উপদেশ-প্রকাশের উৎসাহ দেন। ১৯০৭-এ এই লেখা বই আকারে পুনঃপ্রকাশিত হয়। পাশাপাশি রামচন্দ্র দত্তের অনুরোধে বঙ্গভাষায় লিখতে শুরু করেন ‘কথামৃত’। এরপর ১৯০২ সালে স্বামী ত্রিগুণাতীততনন্দ কর্তৃক প্রথম ভাগ ও পরে ক্রমে ১৯০৪ সালে দ্বিতীয় ভাগ, ১৯০৮ সালে তৃতীয় ভাগ এবং ১৯১০ সালে চতুর্থ ভাগ প্রকাশিত হয় কথামৃত-র।
আরও পড়ুন
বেলুড় মঠে ‘জ্যান্ত দুর্গা’ মা সারদারও পূজা করেছিলেন বিবেকানন্দ
১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয় কথামৃতের পঞ্চম তথা শেষ খণ্ড। যার কয়েক মাস আগেই মারা গেলেন মহেন্দ্রনাথ। আর বাঙালিকে দিয়ে গেলেন তার ইতিহাসের অন্যতম সম্পদ, “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত”।
Powered by Froala Editor