আসতে পারি?
ও আপনি, হ্যাঁ, এই যে আপনার লেখাগুলো নিয়ে যান।
পছন্দ হয়নি নিশ্চয়ই?
আজ্ঞে না। এত নেগেটিভ লেখা কখনো ছাপা যায়?
লেখাটার মধ্যে বানানো তো কিছু ছিল না, চারপাশে যা দেখছি তাই লিখেছি।
চারপাশে পজিটিভ কিছু নেই বলছেন!
আমি হতাশ হয়ে সম্মুখের চেয়ারটায় বসে বললাম-
কী জানেন, আগেকার দিনের মানুষগুলোর মুখে স্বচ্ছতার আলো পড়ত, কিন্তু এখন যে কারোর মুখের দিকে তাকান, দেখবেন একটা না একটা মুখোশ পড়ে আছে। অন্তরে বাহিরে বিশাল বৈপরীত্য। ছোটোবেলায় বেলুনওয়ালা দেখলেই বাবার কাছে বায়না করতাম মুখোশ কিনে দেবার জন্য। আর আজ না চাইতেই এত মুখোশের মাঝে বাস করি যে বেলুনওয়ালার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এসব দেখে কী করে পজিটিভ লেখা আসবে বলুন তো!
প্রকাশক এবার রীতিমতো বিরক্ত হলেন। বললেন-
দেখুন মশাই, আপনার সঙ্গে ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। আমাকে আমার কাজ করতে দিন।
নিরুপায় হয়ে বললাম-
এতক্ষণ যখন নষ্ট করলেন তখন আর পাঁচটা মিনিট যদি দেন। লেখাটা আপনার পছন্দ হবে না আন্দাজ করেছিলাম, তাই আর একটা লেখা নিয়ে এসেছি। খুব ছোট্ট, একটু যদি শোনেন।
প্রকাশক লাফ দিয়ে উঠলেন। কিন্তু তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠলাম-
ভয় পাবেন না, ঘড়ি ধরে ঠিক পাঁচ মিনিট। একটুও এদিক ওদিক হবে না। কালবিলম্ব বা করে ব্যাগ থেকে লেখাটা বার করে পড়তে শুরু করলাম-
কাল রাত্রে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। কোন এক অদৃশ্য মায়াবলে মানুষগুলো সব সরীসৃপ হয়ে গেছে। একটু পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম যার যেমন প্রকৃতি সে সেইরকম রূপ পেয়েছে। কেউ টিকটিকি, কেউ বৃশ্চিক ইত্যাদি। তবে আমি বেশ আমার মনের মতোই রূপ পেয়েছি। বিষধর সর্প। বিষ আছে কিনা প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না। বোঝার জন্য বাগানে গিয়ে দেখি একটা কুকুর শুয়ে আছে। কয়েক বছর আগে আমাকে কামড়েছিল। প্রতিশোধ নেবার প্রবল ইচ্ছা দেখা দিল। মারলাম এক ছোবল। বাছাধন বিষের জ্বালায় ছটফটিয়ে শেষ হয়ে গেল।
নিজের ক্ষমতায় বেশ পুলকিত হলাম। আর আমাকে পায় কে! মনের মধ্যে তিল তিল করে পুষে রাখা রাগগুলোর এবার একটা নিষ্পত্তি করা যাবে।
চক্ষুলজ্জার খাতিরে অনেক কিছু মনের বিপরীতে গিয়ে হাসিমুখে মেনে নিতে হয়েছে। মুখোশের আড়ালে আসল মানুষটাকে লুকিয়ে রেখেছিলাম এতদিন। আজ সু্যোগ এসেছে। কিন্তু প্রতিশোধের তালিকা যে এত বিশাল হবে সে ধারণা আমারও ছিল না। কাকে দিয়ে যে শুরু করব ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। অনেক ভেবে একজনকে নিশানা করলাম।
রাস্তায় বেরিয়ে দেখি এ কি কাণ্ড! চারপাশে যে সব সাপেরাই কিলবিল করছে। টিকটিকি, বিছে এদের সংখ্যা অতি নগণ্য। তার মানে আমার মতো এরাও সব বিদ্বেষ পূর্ণ! মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। এত বিদ্বেষ নিয়ে সবাই এতদিন একসাথে পথ চলেছে কী করে! দূর, এসব ভেবে কী লাভ, সাপের আবার মন হয় নাকি! কার্যসিদ্ধির উদ্দ্যেশ্যে চলতে শুরু করলাম।
গিয়ে দেখি যাকে মারব বলে গেছি সে কেঁচো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চরম শত্রুকে এই অবস্থায় দেখে মনটা দমে গেল। আমার নিজের ভেতরেই এত বিষ ! ফিরে এলাম। আশ্চর্যের বিষয় এই যে প্রতিশোধের তালিকা ধরে কাউকেই ছোবল মারা হল না। আমার মতো বিষধর কেউই নেই। যুদ্ধ যদি সমানে সমানে না হয় তাহলে প্রকৃত যোদ্ধার কাছে তা অসম্মানের। বিফল মনোরথ হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
বাগানে গিয়ে দেখি কুকুরটা মরে পড়ে আছে। ওটাকে মারার পর যে আনন্দ হয়েছিল সেটাও যেন ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল। ইস্, ওকে যদি বাঁচাতে পারতাম! বিষ প্রয়োগ করার ক্ষমতার অধিকারী হলাম, কিন্তু বিষ তোলার ক্ষমতা নেই। এই প্রথম নিজের ওপরেও যেমন করুণা হলো তেমনি বিশ্বসংসারের প্রতি মনটা তিক্ত হয়ে উঠল। সৃষ্টির রূপ আমাদের অজানা অথচ ধ্বংসের কাজে আমরা প্রতিনিয়ত কত পরিশ্রম করে চলি। হঠাৎ কীসের চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে মনে হলো বাগান থেকে আওয়াজটা আসছে। গিয়ে দেখি একটা লোক বাগানের পাঁচিল টপকে পালাচ্ছে আর যে কুকুরটা আমায় কয়েক বছর আগে কামড়েছিল সেই কুকুরটাই চোরটাকে তাড়া করেছে। মনের মধ্যে অখণ্ড শান্তি অনুভব করলাম।
এক নিশ্বাসে লেখাটা পড়ে আর দাঁড়াইনি। প্রকাশক আমাকে এমনিতেই খুব একটা ভালো চোখে দেখেন না, তাই দ্রুতগতিতে স্থান ত্যাগ করলাম।
পরদিন সকালে টেলিফোন এল। প্রকাশক নিজেই ফোন করেছিলেন। নতুন লেখাটা নিয়ে দেখা করতে বললেন। যথাসময়ে গেলাম। লেখাটা হাতে দিলাম। আগাগোড়া পুরোটা পড়লেন। তারপর চশমার পুরু কাঁচের ফাঁক দিয়ে গম্ভীরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
সর্প হয়ে যে শত্রুকে প্রথমে মারতে গেছিলেন সেই কেঁচোটা আসলে কে?
আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। বললাম -
আপনি বিচক্ষণ ব্যাক্তি, ধরেছেন ঠিকই। কিন্ত ওই যে জানেনই তো, নামে কী আসে যায়।
প্রকাশক গম্ভীরমুখে আর একবার জ্বলন্ত দৃষ্টি হানলেন। তারপর বললেন-
লেখাটা রাখলাম, সামনের মাসে দেখা করবেন।
কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সবে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছি বললেন -
পরেরবার যদি এ রকম গল্প লিখতে ইচ্ছে করে তাহলে কেঁচো না করে নকুলের রূপটা দেবেন তাহলে যুদ্ধ না হওয়ার দুঃখটা আর থাকবে না।
লজ্জিত বোধ করলাম।
ফেরার পথে রামপ্রসাদের দু কলি গান হঠাৎ মনে পড়ল…
"মনরে কৃষি কাজ জানো না
এমন মানব জমিন রইলো পতিত
আবাদ করলে ফলতো সোনা"
বেসুরো গলাতেই গুনগুন করতে করতে বাড়ি ফিরলাম।