মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান প্রদেশ। আর এই প্রদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত থান্ডার বে জাতীয় সামুদ্রিক অভয়ারণ্য। উপসাগর বলা হলেও, আদতে ‘থান্ডার বে’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চহ্রদের একটি অংশ বিশেষ। অবশ্য স্থানীয় ভাষায় আরও একটি নাম রয়েছে এই অঞ্চলের— শিপরেক অ্যালি। হ্যাঁ, জাহাজের সমাধিক্ষেত্রই বটে। লেক হুরনের (Lake Huron) এই বিশেষ অংশে শায়িত রয়েছে অন্ততপক্ষে ২০০টিরও বেশি জাহাজের মৃতদেহ। এবার সেখানেই আবিষ্কৃত হল ১৩০ বছরের পুরনো একটি বার্জ ‘আয়রনটন’-এর ধ্বংসাবশেষ।
১৮৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। হুরন হ্রদের মধ্যে দিয়েই ৬০ হাজার কিউবিক ফুটের শস্যবাহী ‘আয়রনটন’ (Ironton) পাড়ি দিয়েছিল মিশিগানের বন্দরনগর মারকেটের দিকে। সঙ্গে ছিল আরও একটি পণ্যবাহী জাহাজ ‘মুনলাইট’। তবে এই দুটি জাহাজই চালিত হত পালের মাধ্যমে। ফলে তাদের গতিবেগও ছিল সীমিত। দ্রুত পণ্য পরিবহনের জন্য তাই এইধরনের জাহাজকে বাষ্পচালিত স্টিমারের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে আসার চল ছিল আমেরিকার গ্রেট লেকে। রেল ইঞ্জিন যেভাবে বাকি বগিদের টেনে নিয়ে যায়, অনেকটা সে-রকমই বন্দোবস্ত।
এই একই ব্যবস্থা করা হয়েছিল ‘আয়রনটন’ ও ‘মুনলাইট’-এর ক্ষেত্রেও। তবে প্রকৃতির সামনে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে এই ব্যবস্থা। কিন্তু কীভাবে? প্রথমত হাওয়ার বিপরীতে যাত্রা। সেক্ষেত্রে পাল টাঙানো হলে গতি কমে যায় জাহাজের। পাশাপাশি যন্ত্রচালিত স্টিমার জাহাজ দুটিকে টেনে যাওয়ায়, বাড়তি করে হাল চালানোর প্রয়োজন মনে করেননি নাবিকরা। আর তাতেই ঘটে বিপত্তি। মাঝ পথে হঠাৎই ভয়াবহ ঝড়ের শিকার হয় জাহাজ দুটি। দড়ি ছিঁড়ে মূল স্টিমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ‘আয়রনটন’। ঝড়ের মুখে পাল খাটানোর সুযোগটুকুও পাননি নাবিকরা। উত্তাল হ্রদের জল গ্রাস করে আস্ত জাহাজটিকে।
৭ জন নাবিকের মধ্যে ৫ জনেরই মৃত্যু হয়েছিল সেই জাহাজডুবিতে। কাঠের তৈরি ফাঁকা ব্যারেলে ভেসে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন বাকি দু’জন। তবে ভাসতে ভাসতে তাঁরাও বহু দূরে চলে যান দুর্ঘটনাস্থল থেকে। ফলে আদতে ঠিক কোন জায়গায় এই জাহাজডুবি হয়েছে— তা রহস্য হয়েই থেকে যায় মিশিগানের বাসিন্দাদের কাছে।
১৯৮৫ সালে ‘ওসান এক্সপ্লোরেশন ট্রাস্ট’ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের পর নতুন করে শুরু হয়েছিল পঞ্চহ্রদে ডুবে থাকা জাহাজগুলির অনুসন্ধান। এই সংস্থাটির ওপরই ভার দেওয়া হয় বিষয়টি তদন্ত করার। দীর্ঘ তিন দশক ধরে গবেষণার পর ২০১৭ সালে অত্যাধুনিক সোনারের মাধ্যমে ‘আয়রনটন’-এর ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করেছিলেন ‘ওসান এক্সপ্লোরেশন ট্রাস্ট’-এর গবেষকরা। এবার ডুবুরি ও ছোটো সাবমেরিনের মাধ্যমেই তাঁরা পৌঁছে গেলেন ধ্বংসস্তূপে।
অবাক করার বিষয় হল, প্রায় ১৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও, আজও সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছে কাঠের তৈরি প্রাচীন বার্জটি। এমনকি অক্ষত রয়েছে তার তিনটি মাস্তুল। অবিচ্ছিন্ন অবস্থায় তার গায়ে জুড়ে রয়েছে দুটি লাইফবোটও। সাম্প্রতিক আবিষ্কার প্রাচীন এই জাহাজের মর্মান্তিক পরিণতির গল্প তো বটেই, সেইসঙ্গে প্রকাশ্যে আনল হুরন হ্রদের আশ্চর্য চরিত্রও। প্রথমত মিষ্টি জলের হ্রদ, সঙ্গে জলের তাপমাত্রা বিশ্বের গড় তাপমাত্রার থেকে অনেক কম হওয়ায় কাঠের বার্জটি অক্ষত রয়েছে বলেই অনুমান গবেষকদের। ফলে, আগামীদিনে হুরন হ্রদের চরিত্র বুঝতে এই আবিষ্কার বিশেষভাবে সাহায্য করবে বলেই ধারণা বিজ্ঞানীদের…
Powered by Froala Editor