ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নিচে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ - যে আবিষ্কারে চমকে উঠেছিল গোটা বিশ্ব

৯/১১ – এই সংখ্যাগুলো এভাবে দেখলে এখনও অনেকেই সেই মর্মান্তিক সন্ত্রাসবাদী হামলার দৃশ্যটি চোখের সামনে দেখতে পান। মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যটি বৈদ্যুতিক গতিতে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল, ফুটে উঠেছিল  টেলিভিশনের পর্দায়। একের পর এক দুটি প্লেন এসে ধাক্কা দিচ্ছে, অবিশ্বাস্য ভয়াবহতার মধ্যে ভেঙে পড়ছে ওয়ার্ল ট্রেড সেন্টারের দুটি গগনচুম্বী নির্মাণ।  সেই ঘটনাকে জড়িয়ে এখনও অনেক রকম 'কনস্পিরেসি থিওরি'র তথ্য ভাসে বৈদ্যুতিক মাধ্যমে। সেই ঘটনার পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 'শান্তি স্থাপন' করার দায়িত্ব নিল আফগানিস্তানে। তারপর ইরাক, তারপর লিবিয়া, তারপর সিরিয়া, তারপর...

কিন্তু এই সব কিছুর মাঝেই হঠাৎ একদিন একটা ঘটনা ঘটল –

১৩ই জুলাই, ২০১০-এর সকালে নিউ ইয়র্কের লোয়ার ম্যানহাটনে খননকার্যে থাকা শ্রমিকদের একটি দল মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে হঠাৎই আবিষ্কার করল একটি কাঠের পাটাতনের মত কিছু। আসলে, সেই জায়গাটিতেই একসময় দাঁড়িয়ে থাকত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের জোড়া ইমারত। ধ্বংসের পর তাদের অবশেষ সরাতে যায় অনেকটা সময়, ২০১০-এও চলছিল সেখানে ভিত সংস্কারের কাজ। মাটি থেকে প্রায় ২২ ফুট (৬.৭ মিটার) গভীরে উঁকি দিল একটি প্রাচীন কাঠের পাটাতন... গ্রাউন্ড জিরো থেকে সামান্য দক্ষিণে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগায়, সেই দলের ভারপ্রাপ্ত কর্তার নির্দেশ দিলেন সযত্নে কাছাকাছি মাটি সরিয়ে কাঠের পাটাতনটি উদ্ধার করতে। মাটি সরাতে সরাতে দেখা গেল, পাটাতন কোথায়, এ যে আস্ত জাহাজের অবশেষ – যাকে বলে, হাল্ক!

পরীক্ষা করে জানা গেল, প্রায় আড়াইশো বছরের প্রাচীন এক জাহাজের অবশেষ এটি। কাঠ-নির্মিত এই জাহাজটি সেই সব গাছের কাঠ থেকে তৈরি, যা দক্ষিণ-পূর্ব পেনসিলিভেনিয়ার জঙ্গল থেকে আনুমানিক ১৭৭৩ সালে কেটে নেওয়া হয়েছিল টিম্বার উৎপাদনের জন্য।

অথচ বিস্ময়, আগে যখন ওয়ার্ল ট্রেড সেন্টার নির্মিত হয়েছিল, তখন ভিতের কাজ করার সময় মাটি খোঁড়া হলেও এই জাহাজের অবশেষটি কারও নজরেই আসেনি।

২০১০-এ উদ্ধার হওয়া জাহাজের অবশেষটি এবং তার থেকে সংগৃহীত দ্রব্যগুলি নিয়ে দীর্ঘ চার বছর নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর, অবশেষে ২০১-৪তে প্রকাশিত হয় রিসার্চ-পেপারটি। এডওয়ার্ড কুকের মতো (নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বলয় বিশেষজ্ঞ) বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্ডিপেন্ডেন্স হল (যেখানে আমেরিকার ঐতিহাসিক স্বাধীনতা লাভের ঘোষণা হয়েছিল এবং সংবিধানে সাক্ষর হয়েছিল) এবং সেই যুগে ফিলাডেলফিয়ার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইমারত গড়ে উঠেছিল এমনই সব কাঠের উপাদান দিয়ে। এগুলি দক্ষিণ-পূর্ব পেনসিলভেনিয়া, মানে সেই জঙ্গল থেকেই সংগ্রহ করা হয়, যেখান থেকে এই জাহাজটির কাঠ সংগ্রহ করা হয়েছিল। মূলত হিকরি, স্প্রুস, পাইন, ওক - এমন সব গাছের টিম্বার দিয়েই জাহাজটি নির্মিত হয়েছিল। মূল কাঠামো তৈরি হয়েছিল সাদা ওকের টিম্বার দিয়ে।

এই ধরণের ছোট মাপের জাহাজকে বলা হয় স্লুপ। এবং, সম্ভবতঃ ফিলাডেলফিয়ারই কোনও ছোটখাটো শিপইয়ার্ড (জাহজ নির্মাণের কারখানা) থেকে এই জাহাজটি তৈরি করা হয়। ব্যবহৃত কাঠগুলোর সকলেরই বলয়-সংখ্যা প্রায় এক, তারা একই সময়কালীন এবং একই ধরণের।  কাছাকাছি ছোট-মাঝারি মানের শিপইয়ার্ডেই এমন একই ধরণের কাঠ থাকবে। প্রয়োজনমত টিম্বার আনিয়ে জাহাজ নির্মাণ করাই তাদের সাধ্যের মধ্যে। এবং সেই কাঠ আনানোও হ'ত কাছাকাছি উৎস থেকে। বড় শিপইয়ার্ডে অনেক টিম্বার মজুত থাকত। তাদের বয়সও আলাদা, ধরণও আলাদা।

এই ধরণের স্লুপ বা ছোট জাহাজের ব্যবহার হ'ত ডেলাওয়্যার নদীতে পণ্যবাহী জাহাজ হিসেবে। এই জাহাজটির শরীরে পাওয়া ঝিনুকের অবশেষ থেকে বোঝা যায়, একেবারে ব্যর্থ জীবন ছিল না তার। জাহাজের অবশেষ থেকে উদ্ধার হওয়া কিছু সামগ্রী থেকে উঠে এসেছে আরও চমৎকার কিছু তথ্য। একটি ছোট্ট ধাতব বোতাম উদ্ধার হয়, যার ওপর ইংরেজিতে ৫২ সংখ্যাটি লেখা। বোঝা যায় ব্রিটিশ ৫২তম রেজিমেন্টের কোনও সামরিক সদস্যের কোটের বোতাম এটি। সেই সামরিক দলের সদস্য, যারা আমেরিকার বিপ্লব দমন করার জন্য লড়তে এসেছিল। আরও চমক আছে। এই জাহাজের গর্ভ থেকে উদ্ধার হয়েছে বেশ কিছু গোলাগুলির মরচে ধরা অবশেষ। সেই যুগে আমেরিকায় তৈরি এবং ব্যবহৃত বেশ কিছু মাস্কেট বল, এবং একটি ফরাসি ক্যানন বল।

অনুমান করা যায় এই পণ্যবাহী জাহাজটিতে মদ, চিনি, এমনকি ক্রীতদাসও বহন করে নিয়ে যেওয়া হত নিকটবর্তী সমুদ্রপথে।

কিন্তু জলে ডুবে গিয়েছিল, না ইচ্ছে করেই বাতিল করে দেওয়া হয় - তা হলফ করে বলা মুশকিল। বেশ কিছুকাল ডেলাওয়্যার নদীতে বা নিকটবর্তী সমুদ্রপথে চলাচল করার পর, তার শরীরে দেখা দেয় শিপ-ওয়োর্ম (Lyrodus pedicellatus) নামক একরকম কীটের সংক্রমণ (কাঠের ওপর ছোট ছোট গর্ত ও দাগ থেকে তা স্পষ্ট)। নোনা জলে অথবা উষ্ণ আবহাওয়ায় জাহাজ বা নৌকোর কাঠে এমন সংক্রমণ হতে দেখা যায়। এর থেকেই ধারণা করা যায়, জাহাজটি সমুদ্রপথে যাত্রা করেছিল... হয়ত ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দিকে?

আনুমানিক কুড়ি বছরের মধ্যেই এই জাহাজটি বাতিল হওয়ার মূল কারণ হতে পারে এমন সংক্রমণ। বাতিল হওয়ার পর, জাহাজটিকে নিয়ে আসা হয় ম্যানহাটনে। তখন ১৭৯০ সাল, হাডসন নদীর তটে মাটি ফেলে ব্যবহার-যোগ্য স্থলভাগ বিস্তার করা হচ্ছে... আয়তনে বাড়ছে নিউ ইয়র্ক শহর। 'ল্যান্ডফিল' হিসেবে মাটি ভরাট করার কাজে ব্যবহার হয়ে গেল এই ছোট জাহাজটি। চাপা পড়ে গেলে মাটির নিচে, স্বল্প ইতিহাস আর বিস্মৃতি নিয়ে। অথচ কেমন ভাগ্যের পরিহাস, প্রায় দুশো কুড়ি বছর পর হঠাৎই একটি বিতর্কিত জায়গায় আত্মপ্রকাশ করে সবার দৃষ্টি এবং কৌতূহল নিজের দিকে টেনে নিল সেটি।

এবারে কাব্যিক সমাপতনটি লক্ষ্য করুন। পাটাতনে পাওয়া কাঠগুলির বলয় পরীক্ষা করে গাছগুলির বয়স জানা সম্বন্ধে যা তথ্য প্রকাশ হচ্ছে তা এমন –

প্রাচীনতম বলয়টির বয়স আনুমানিক পনেরো শতকের শেষের দিকে, যখন কলোম্বাস আকস্মিক ভাবে এসে পড়েছিলেন আমেরিকার কাছাকাছি। আর নবীনতম বলয়টি (যখন গাছটি কেটে ফেলা হয়), তার বয়স ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দ; যখন আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিযুগ। বোস্টন টি পার্টির বছর। এ যেন আমেরিকার ইতিহাসেরই একটা খণ্ড হঠাৎ বেরিয়ে এল এত বছর পর। জাহাজটির প্রতিটি পাটাতন সযত্নে পুনর্নির্মাণ করে একটি চেহারা দেওয়া হয়েছে তাকে। এটি এখন নিউ ইয়র্কেরই একটি সংগ্রহশালার নিদর্শন।

কেউ ও-দেশে পাড়ি দিলে একবার খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। চাক্ষুষ করে আসবেন ইতিহাসের এই অতিসাধারণ অথচ বিরল নিদর্শনটি। 

More From Author See More