ফিনিশিং লাইনে প্রথমে পৌঁছেও অধরা স্বর্ণপদক, ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের বিস্মৃতপ্রায় এক অধ্যায়!

১৯৬০-এর রোম অলিম্পিক। সেবার ৪০০ মিটারের দৌড়ে ফেভারিটদের তালিকায় অন্যতম ছিলেন এক ভারতীয় অ্যাথলিট। মিলখা সিং। তবে ফাইনালে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও ছোট্ট ভুলের মাশুল দিতে হয় তাঁকে। চতুর্থ স্থানে দৌড় শেষ করতে হয়েছিল মিলখাকে। সেই অনুশোচনা তাঁকে তাড়া করে বেরিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। 

অবশ্য মিলখার এই কাহিনি জনপ্রিয় হলেও, আমরা ভুলে গেছি এমনই আরেকটি কাহিনি। এক ভারতীয় মহিলা অ্যাথলিটের কালজয়ী প্রয়াস। ১৯৮৬ সালের সেওল এশিয়ান গেমস। ৮০০ মিটারের দৌড় প্রতিযোগিতার ফাইনাল। প্রথম থেকেই সেই রেসে বাকিদের পিছনে ফেলেছিলেন তিনি। এমনকি ফিনিশিং লাইনেও পৌঁছে গিয়েছিলেন সবার প্রথমে। ভারতের প্রথম মহিলা হিসাবে এহেন কীর্তি তাঁরই। তবে ভাগ্য সহায় হয়নি। স্কোরবোর্ডে পয়েন্ট ফুটে উঠতেই দেখা যায়, প্রথম স্থান অধিকার করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার লিম চুন-ইয়া। এও কী সম্ভব? আসলে দৌড়ের সময় ইনার লাইন থেকে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে সেবার ডিসকোয়ালিফাই করা হয়েছিল ভারতীয় অ্যাথলিটকে। 

শাইনি আব্রাহাম উইলসন (Shiny Abraham Wilson)। আশির দশকে পিটি উষার সঙ্গে একই মঞ্চে একাধিকবার অংশ নিয়েছেন তিনি। দৌড়েছেন পাশাপাশি। দেশকে এনে দিয়েছেন একাধিক পদক। তা সত্ত্বেও, আজ বিবর্ণ হয়ে উঠেছে ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের সেই বর্ণময় অধ্যায়। 

১৯৬৫ সালে কেরলের ইদ্দুকি জেলায় এক খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম শাইনির। শৈশব থেকেই অ্যাথলেটিক্সে আগ্রহ ছিল প্রবল। সেই সূত্রেই তিনি ভর্তি হন কোয়াট্টামের একটি ক্রীড়া অ্যাকাডেমিতে। মজার বিষয় হল, সেখানে তাঁর সতীর্থ ছিলেন আরও দুই কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ— পিটি ঊষা এবং এমডি ভালসাম্মা, যিনি কিনা এশিয়ান গেমসে সোনা জেতা ভারতের দ্বিতীয় অ্যাথলিট। 

১৯৮১ সালে প্রথমবার জাতীয় মিটে অংশ নিয়েই সোনা জেতেন শাইনি। ৮০০ মিটারের দৌড়ে হয়েছিলেন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। এখানেও আরও একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন। আর তা হল, অবসরের আগে পর্যন্ত অর্থাৎ টানা ১৪ বছর ধরে ৮০০ মিটারের দৌড়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি। যাই হোক, প্রসঙ্গে ফেরা যাক। শাইনি আব্রাহামের জয়যাত্রা শুরু হয় এরও বছর চারেক পর থেকে। তখন কেরলের আলফানসো কলেজের ছাত্রী তিনি। প্রথমবার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য দেশের জাতীয় শিবিরে সুযোগ পেয়েছিলেন শাইনি। অংশ নিয়েছিলেন জাকার্তায় আয়োজিত এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে। 

সেবার দেশকে ৮০০ মিটারের দৌড়ে এনে দিয়েছিলেন একটি সোনা। অন্যদিকে ৪০০ মিটারের দৌড়ে দ্বিতীয় হয়ে পেয়েছিলেন রৌপ্যপদক। জাকার্তার এই সাফল্যের পর ধারাবাহিকভাবেই এশিয়ান গেমস, এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ এবং অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন শাইনি। সবমিলিয়ে ৭৫ বার ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। এনে দিয়েছেন ৭টি সোনা, ৫টি রুপো এবং ২টি ব্রোঞ্জ।

তবে নিঃসন্দেহে আরও দীর্ঘ হতে পারত এই ট্যালি। ১৯৮৬-এর সেওলে এশিয়ান গেমসের কথা তো বলাই হয়েছে শুরুতে। সেবার সেওলে যে নজির গড়েছিলেন শাইনি, তা এখনও পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেননি দ্বিতীয় কোনো ভারতীয় মহিলা অ্যাথলিট। ২০১৪ সালে টিনটু লুকা এশিয়ান গেমসের ৮০০ মিটারে রুপো আনলেও, আজও অধরা রয়ে গেছে স্বর্ণপদক। অবশ্য, আব্রাহাম ’৮৬-এর এশিয়ান গেমসের সেই ভুল কড়ায়গণ্ডায় শোধ করেছিলেন ঠিক তার পর দিনই। ৪০০ মিটার দৌড়ে জিতেছিলেন রৌপ্য পদক। অন্যদিকে সোনা জিতে নজির গড়েছিলেন তাঁরই সতীর্থ পিটি ঊষা। তাছাড়াও সেবার ৪০০ মিটার রিলে রেসেও সোনা জেতেন তুই ক্রীড়াবিদই। 

তবে পদক জেতার বাইরেও তাঁর সবচেয়ে বড়ো সাফল্য, প্রথমবার অলিম্পিকের মঞ্চে মহিলা বিভাগে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ভারতকে সেমি-ফাইনালে পৌঁছে দেওয়া। ১৯৯৫ সালে সাফ গেমসে ৮০০ মিটারের দৌড়ে নতুন রেকর্ড তৈরিও হয়তো জায়গা পায় এই তালিকায়।

আশির দশকে অর্জুন পুরস্কার এবং ১৯৯৫ সালে খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর পদ্মশ্রী পুরস্কারও পেয়েছেন কেরালাইট দৌড়বিদ। তবে তা সত্ত্বেও কালের আবহেই হারিয়ে গেছে তাঁর নাম। দেশের ক্রীড়া পরিকাঠামোই বা কতটুকু মনে রেখেছে তাঁকে? তবে এ-ধরনের ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব নতুন করে দেশের হাল ধরলে অনুপ্রাণিত হবে তরুণ-তরুণীরা, তাতে আর আশ্চর্যের কী?

Powered by Froala Editor