না, ধার ঘেঁষে শান্ত নদীটি নেই কোনো। কিন্তু ‘পটে আঁকা ছবিটি’ বলা যেতেই পারে। অন্তত, বছরের অন্যান্য দিন এই পথ ধরে যেতে যেতে চোখ পড়লে, তেমনটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। ছোট্ট একটা একতলা বাড়ি— বাড়ি না বলে একটা ঘর বলাই ভালো। শুধু, কটেজ-আকৃতির মাথা ও তার ওপর বসানো ক্রুশ দেখে থমকে যেতে হয়। গির্জা! এই ঘোর মফস্সলে গির্জা বানাল কে! আগে তো দেখিনি!
প্রথম দেখা মাসছয়েক আগে। তবে খবর কানে এসেছিল, তাও ছয়-সাত বছর হয়ে গেল। বেলঘরিয়া— আমার জন্মস্থানের প্রতিবেশী আগরপাড়ার বুকেই লুকিয়ে রয়েছে ছোট্ট এক গির্জা। এক বন্ধুই হদিশ দিয়েছিল। সেই থেকে কৌতূহল। – ‘নিয়ে যাবি?’ – ‘হ্যাঁ!’ অথচ সেই হ্যাঁ’ আর কোনোদিন সত্যি হয়ে ওঠেনি। এদিক-ওদিক খোঁজখবর করেও বিশেষ হদিশ পাইনি। তবে, বন্ধুটি মোক্ষম এক তথ্য দিয়েছিল। ‘বছরে মাত্র একদিন— ২৫ ডিসেম্বরই খোলা হয় চার্চটা। বাকি সারাবছর বন্ধই থাকে।’ অবাক হয়েছিলাম। এ কেমন গির্জা! সেই থেকে তক্কে-তক্কে থাকা, কোনো-না-কোনোবার ২৫ ডিসেম্বর যেতে হবে, হাতেনাতে পাকড়াও করবই। আগরপাড়ার মতো মফস্সল, যার ইতিহাস ও বর্তমানের দূর-দূরান্তেও গির্জার প্রাসঙ্গিকতা নেই, সেখানে এমন ব্যতিক্রমের কারণ কী?
ইতিহাসের মজাই এই। কোন অধ্যায়ের কোন পাতায় যে প্রসঙ্গ লুকিয়ে রাখে, তা বাইরে থেকে বোঝা দুষ্কর। কে বলেছে, আগরপাড়ায় গির্জা ছিল না কখনও? সেই ১৮৩৭ সালেই তৈরি হয়েছিল একটি গির্জা, হুগলি নদীর ধার ঘেঁষে। আর নেহাত ছোটোও নয়, ৩১ ফুট উঁচু। তার চূড়া আবার ৭৪ ফুটের। ৫০০ মানুষ থাকতে পারতেন সে-গির্জায়। জনৈক মিস উইলসন তৈরি করেন এটি। সঙ্গে মেয়েদের জন্য একটি অনাথ আশ্রম এবং ছেলেদের স্কুল। বলাই বাহুল্য, খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগেই সম্ভব হয়েছিল এতকিছু। এগুলির জন্য সে-আমলে আগরপাড়াকে ‘খ্রিস্টান ভিলেজ’ও বলতেন কেউ কেউ। অশোক মিত্র তাঁর ডিস্ট্রিক্ট হ্যান্ডবুকে ও পরবর্তীকালে ‘পশ্চিমবঙ্গের পূজা, পার্বণ ও মেলা’ বইয়ে নথিভুক্ত করেছেন সেই গির্জার কথা। কিন্তু কোথায় গির্জাটি? সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সেই গির্জা একদিন ভেঙে পড়ে। উনিশ শতকেই। পরিত্যক্ত হয় স্কুলটিও। এখনও ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলে গেলে দেখতে পাওয়া যায় স্কুলের ধ্বংসাবশেষ। আর গির্জা? চিহ্ন নেই কোনো। সেখানে গড়ে উঠেছে গিরিবালা মন্দির। সে আরেক প্রসঙ্গ। এ-আলোচনায় না টানলেও চলে।
আরও পড়ুন
যিশু নন, বড়োদিনে জন্মেছিলেন সূর্যদেব— এমনটাই বিশ্বাস ছিল প্রাচীন রোমানদের
সে-কৌতূহল মিটবে খানিক পরে। তার আগে, ২৫ ডিসেম্বরের সান্ধ্য-গির্জাটির বর্ণনা দিই। সামনে ছোট্টো উঠোন, মাথায় আলোর চাঁদোয়া। সেসব পেরিয়ে ঘর। মাথা কটেজ-আকৃতির, ওপরে ক্রশ বসানো, আগেই বলেছি। একটা ফলকে লেখা – ‘সেন্ট জন চার্চ, শিমুলতলা, এস্টাবলিশড – ১৯৮২’। বোঝা গেল, পোশাকি নাম ‘সেন্ট জন চার্চ’। মূল ঘরের বাইরে, দুপাশে মাদার টেরিজা ও মেরি-র মূর্তি। সামনে মোমবাতি জ্বলছে কয়েকটি। গির্জার ভেতরটিও অনাড়ম্বর। খানকয়েক চেয়ার, দুটি বেঞ্চ ও বেঞ্চের ওপারে আরাধনার জায়গা। দেওয়ালে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ছোট্ট মূর্তি। তার নিচে ‘দ্য লাস্ট সাপার’-এর অপটু ছবি— পোস্টার। সামনে টেবিল, ওপরে ক্রুশ, ফুলদানি, পানপাত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র। তার ঠিক নিচেই যেন রাসের আসর। যিশুর জন্মদৃশ্য। মেরি আছেন, আছেন দেবদূত, দুজন পুরুষ, ভেড়া গরু ইত্যাদি। পিছনের দেওয়ালে মাদার টেরিজার ছবি, দেওয়ালে কুলঙ্গিতে মেরি। এছাড়াও রয়েছে দুটি স্বতন্ত্র মূর্তি। এইটুকুই। ছিমছাম আয়োজন। যিশু-জন্মের দিন বলে, ফুল-মালা-মোমবাতির সমারোহ। টুনি লাইট লাগানো, দেওয়াল থেকে ঝুলছে প্লাস্টিকের ঝালর। ও হ্যাঁ, গির্জাঘরটির দেওয়ালে যিশুর জীবনের বিভিন্ন ঘটনার ছোটো-ছোটো ভাস্কর্য, ফ্রেম করে ঝোলানো।
১৯৮২ সালে তৈরি এই গির্জা, আগেই বলেছি। ফলে প্রাচীনত্বের ছাপ নেই বিশেষ কোথাও। আয়োজন ও সজ্জায় অর্থপ্রাচুর্যের চিহ্ন নেই, বরং সরল ও আন্তরিক। মফস্সলের গির্জা, যারা বিখ্যাত নয়, এমনই কি হয়? কী কারণে তৈরি হয়েছিল এই গির্জা? প্রশ্ন পাক খেতে লাগল আবার। স্থানীয় লোকজন আসছে-যাচ্ছে। বড়োদিন ও হাতের কাছে গির্জা বলেই যে যৎসামান্য ভিড়, বোঝা যায় বেশ। বিড়বিড় প্রার্থনা, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, সেলফি ইত্যাদি শেষে ফিরে যাওয়া। শ্যেনদৃষ্টিতে দেখছি— এঁরা কি সকলেই ভ্রাম্যমাণ, না গির্জার সঙ্গে জড়িতও কেউ আছেন— কোনো স্থানীয় খ্রিস্টান, যাঁদের তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হয় এই গির্জা?
অনেকক্ষণ বাদে এক ভদ্রলোকের হাবভাব দেখে সন্দেহ হল, ইনি হতে পারেন। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করলাম। ভুল করিনি। ভদ্রলোক সত্যিই এই গির্জার সঙ্গে যুক্ত। বলা ভালো, গির্জাটির তত্ত্বাবধান তিনিই করেন। সুভাষ মণ্ডল। নাম শুনে বোঝার উপায় নেই, খ্রিস্টান যে। টি-শার্ট ও প্যান্ট পরা, মাথায় জংলা টুপি। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, শ্যামলা রং, ঈষৎ স্থূল। বয়স পঞ্চাশোর্ধ হবে।
সে যাক। একজনকে পেয়েছি যখন, ছাড়ান নেই। আমার একের পর এক প্রশ্ন, আর সুভাষবাবুর ধৈর্যশীল উত্তর।
- ১৯৮২ সালে হঠাৎ এই আগরপাড়ায় গির্জা বানানোর দরকার পড়ল কেন?
- আসলে কী জানেন, তখন শিমুলতলায় সাতটা খ্রিস্টান পরিবার বসবাস করত। তিন ঘর ক্যাথলিক ও চার ঘর প্রোটেস্ট্যান্ট। তখন আমরা প্রার্থনায় যেতাম ব্যারাকপুরের সেন্ট জোসেফ চার্চে। এখনও, শিমুলতলা গির্জা-সহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি গির্জা সেন্ট জোসেফ চার্চেরই অধীনে। তো, সেই ১৯৮২ সালে আমরা ভাবলাম, এখানেই একটা গির্জা বানানো যাক। এখানে একটা গির্জা হলে আমরা উপাসনাক্ষেত্রও পাব, আর গির্জা থাকায় এলাকায় খ্রিস্টান পরিবারের সংখ্যাও বাড়তে পারে। তা আর হল কই!
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুভাষ মণ্ডল। তাঁর মনোদুঃখে অবশ্য আমার মন নেই তখন। কথার সূত্র ধরে আরও প্রশ্ন ভিড় করছে মাথায়।
- তাহলে কি ওই সাতটি পরিবার মিলেই দেখভাল করেন গির্জাটির? এখনও সাতজনই আছে, না আরও কমেছে?
- প্রথমে তো ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্টরা একসঙ্গেই উপাসনা করত এখানে। পরে প্রোটেস্ট্যান্টরা পাশেই পশ্চিমপল্লিতে নিজেদের জন্য আলাদা গির্জা বানিয়ে চলে যায়। এখন শিমুলতলার তিনটিমাত্র ক্যাথলিক পরিবারই রয়েছে এই গির্জার সঙ্গে জড়িয়ে।
- বলেন কী! মাত্র তিনটি পরিবারের জন্য সারা বছরের এত রক্ষণাবেক্ষণ!
- না না, ব্যাপারটা খানিক আলাদা। এই গির্জার সদস্য সেই ১৯৮২ সালেও ছিল মোট ২৬টি পরিবার। ১৪টি ক্যাথলিক ও ১২টি প্রোটেস্ট্যান্ট। শিমুলতলার সাতটি, আগেই বলেছি। তা ছাড়াও, আশেপাশের নাটাগড় সোদপুর মধ্যমগ্রাম ইত্যাদি জায়গাতেও এই গির্জার সদস্য আছে। প্রোটেস্ট্যান্টরা আলাদা হয়ে যাওয়ার পর, এখন ১৪টি ক্যাথলিক পরিবার এর সঙ্গে জড়িত। তারা এখানেই প্রার্থনা করে।
- বছরে মাত্র একদিন খোলা হয় এই গির্জা— ২৫ ডিসেম্বর? বাকি সারাবছর বন্ধ থাকে?
- একদমই তা নয়। প্রতিমাসে একবার করে— একটা রবিবার। ব্যারাকপুর থেকে ফাদার— ফাদার অ্যান্টনি আসেন, তিনিই প্রেয়ার করে যান। মাসে একদিনের বেশি সময় দিতে পারেন না উনি। এই তো, আজ সকালেই এসেছিলেন। আবার পয়লা জানুয়ারি আসবেন।
সুভাষবাবু থামলেন। আমিও, ওঁর থেকে চোখ ফিরিয়ে অপলক তাকিয়ে রয়েছি ‘শিশু’ গির্জাটির দিকে। ওঁর কথামতো, বছর চল্লিশেক আগেও চারপাশে ছিল ঘন বাঁশবন। তারই মাঝে, ছোট্ট একটা মাঠে গড়ে তোলা এই গির্জা। বর্তমানে জড়িত চোদ্দোটি পরিবারের অর্থসাহায্যেই চলে দৈনন্দিন কাজকর্ম। তবে, বড়ো কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হলে অনুদান আসে ব্যারাকপুরের গির্জা থেকে। মাসে একটি করে রবিবার ওই চোদ্দোটি পরিবারের সদস্যরা জড়ো হন, প্রার্থনা জানান যিশুর কাছে। বেশ তো! আগরপাড়ার এককোণে এই গির্জার আড়ালেও যে এত গল্প লুকিয়ে, কে জানত!
সুভাষবাবু জানেন না, আগরপাড়াতে প্রায় ২০০ বছর আগে আরেকটি গির্জা ছিল। তার আকার-আয়তন ছিল তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। জন্মাবধি সে-তথ্য শোনেননি। ব্যারাকপুরের গির্জা আর পরবর্তীতে এই শিমুলতলা গির্জা— এই তাঁর, তাঁদের গণ্ডি। আচ্ছা, শিমুলতলার এই যে তিনটি খ্রিস্টান পরিবার, সে-এ-ই প্রাচীন মিশনারিদের দ্বারা ধর্মান্তরিত? বংশপরম্পরায় তাঁদেরই উত্তরসূরিরা থেকে গেলেন, গড়ে তুললেন পটের ছবির মতো নতুন গির্জাটি?
মনে-মনে চাইছিলাম, তাই যেন হয়। আগরপাড়ার ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক নিরুচ্চার দলিল হয়ে থাকত সেই পরম্পরা। কিন্তু সুভাষবাবু আমার মন ভেঙে দিলেন। ‘আমাদের আদি বাড়ি তো নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। আমার বাবার কর্মসূত্রে এখানে এসেছিলেন। এখানে যে-কটি খ্রিস্টান পরিবার, প্রায় প্রত্যেকেরই সেভাবেই আসা। আগরপাড়ার আদি ভূমিপুত্র নয় কেউই।’
অথচ, ফিরে এসে, এ-লেখা লেখার সময়ও আশা ছাড়তে পারিনি। সুভাষ মণ্ডল ঠিক জানেন তো? কেউ নেই— কেউই কি নেই, সে-সময়ের উত্তরসূরি হয়ে? তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে, উত্তরে নম্র ‘ওয়েলকাম’ শুনে চলে এসেছি। আগরপাড়ার এই গির্জাটি নিয়ে এর আগে কেউ কোথাও লেখেনি। প্রয়োজন বা তাৎপর্য কতটা— সে-প্রশ্নও উঠতে পারে। তবু 'অগ্রপল্লী'— আগরপাড়ার এককোণে গির্জা তৈরির আড়ালে যেটুকু গল্প, তাও তো ফেলনা নয়। হয়তো আরও অনেক মফস্সলের এমন অনাড়ম্বর গির্জার পিছনেও লুকিয়ে কমবেশি এমনই কাহিনি। একটি নবীন গির্জার জন্ম-ইতিহাস ও তার টিঁকে থাকার লড়াই সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে কতটা আকর্ষণীয়, জানি না। আমি শুধু দেখতে পাই মফস্সলের খোয়া-বাঁধানো রাস্তা, আলো-আঁধারি পরিবেশ ও তার পাশে কী নিবিড় একটি গির্জার দাঁড়িয়ে থাকা। আরেকটু কুয়াশা-আড়াল ও সাধারণ দিন হলে, গেরস্থের ঘর বলে ভুল করে ফেলতাম যাকে।
ছবি - দেবায়ন বোস ও তন্ময় ভট্টাচার্য
Powered by Froala Editor