বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে, আর তার এক সার্থক উদাহরণ হাসির রাজা শিবরাম। হ্যাঁ হিল্লি-দিল্লি তিনি করেননি বটে, কিন্তু চরকিবাজির মত ঘুরেছেন কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ। আর এই অনন্ত, অক্লান্ত সফরের মধ্য দিয়েই কুড়িয়ে নিয়েছিলেন অসংখ্য বাঙালি পাঠকের মন ভালো রাখার উপাদান।
শিবরাম চক্রবর্তী – যার কলমের জাদুতে হেসেছেন আট থেকে আশি অথচ সেই হাসির রাজার জীবনযুদ্ধ শুরু হয় নিতান্ত ছোট্ট বয়স থেকেই। 'বাড়ি থেকে পালিয়ে'-এর নায়ক নিজেও একসময় বাড়ি থেকে বেমালুম উধাও হয়ে যান। থিতু হলেন এক্কেবারে কলকাতায়। অবশ্য মাথার উপর ছাদ জোটেনি তখনও, ঠিকানা বলতে কখনও সস্তার ধর্মশালা কখনও কারও বাড়ির রোয়াক আবার কখনও একবারেই ফুটপাথ। সে না হয় হল, কিন্তু দানাপানির ব্যবস্থা কী হবে? রোজ রোজ তো আর হরিমটর দিয়ে দিন চলে না! তার উপর শিবরাম সেই ছোট্ট বয়স থেকেই ভোজনরসিক। অতঃপর শুরু হল কাগজ ফেরি।
স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারত তখন উত্তাল। বিপ্লবীদের আমরণ সংগ্রাম যেমন আরও হাজার হাজার ছাত্র-যুবককে উদ্বুদ্ধ করেছিল মরণপণ লড়াইয়ে, তেমনি বাতাস প্রতিমুহূর্তে ভারী হয়ে উঠছিল স্বজন হারানোর কান্নায়। এমন সময় শিবরাম কি পিছিয়ে থাকতে পারেন? ব্রিটিশদের অত্যাচার আর তীব্র দমননীতি সেদিন চোখ খুলে দিয়েছিল একরত্তি শিবরামের। মানুষের দুঃখ কষ্ট দুর্দশা সেদিনই শিবরামকে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল দেশপ্রেমে। আর দেশের মানুষের দুঃখই যদি না বুঝলেন, তাহলে পরবর্তীকালে তাদের হাসির জোয়ারে ভাসাবেন কী করে?
শিবরাম তখনও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করেননি, অথচ জড়িয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা যত বাড়ছিল ততই দেশের ছাত্র-যুবকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিলো এই হার না মানা লড়াইয়ে। একসময় শিবরামের উপর অর্পিত হল এক গুরুভার। এক অত্যাচারী সাহেবকে নিকেশ করতে হবে। শিবরাম জানতেন এর শেষ পরিণতি, কিন্তু একবারের জন্যও সেদিন পিছিয়ে আসার কথা ভাবেনি সেদিনের সেই একরত্তি শিবরাম। স্বাধীনতা আন্দোলনের দলিলে শিবরাম চক্রবর্তীর নাম হয়তো লেখা হতো স্বর্ণাক্ষরে, কিন্তু বিধি বাম। হাতের মুঠোয় পেলেও সেদিন সাহেবকে মারতে পারেননি শিবরাম। কারণ কী? সাহেব যে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সেই অনুষ্ঠানেই গান গাওয়ার কথা শিবরামের। ফলে অত্যাচারী সাহেবকে হত্যাটা তখনকার মতো মুলতুবি রাখতে বাধ্য হলেন তিনি।
পরবর্তীকালে, মুক্তারাম স্ট্রিটের মেস হয়ে উঠেছে কলকাতার বুকে শিবরামের স্থায়ী বাসস্থান। এই মেসবাড়িতে বসেই স্বপ্নের সাতরঙা রামধনু রচনা করতেন তিনি। আর মুক্তারাম স্ট্রিটের এই মেসবাড়িতেই চোরের উপদ্রব শুরু হল একদিন। অবশ্য উপদ্রব হয়তো ঠিক বলা যায় না, কারণ চোর এসেছিল একদিনই আর সেটাও স্বয়ং শিবরাম চক্রবর্তীর ঘরে। চোর এসে তো হতভম্ব, একি অবস্থা! নেবার মতো যে কিছুই নেই। অন্যদিকে শিবরামবাবু তখন ছিলেন না ঘরে, ফিরে এসে দেখেন বালিশের উপর দশ টাকার একটি নোট আর একটি চিরকুট। সেই চিরকুটে লেখা - ঘরে তো নেবার মতো কিছুই নেই, এই দশটা টাকা রেখে গেলুম, এই দিয়ে ধুপকাঠি কিনে তা ফেরি করুন।
প্রতিবেদনের শেষটাও বড্ড বেশি বিয়োগান্তক হয়ে যাচ্ছে। অথচ শিবরামের জীবনেও আছে হাজারো ট্র্যাজেডি। যে মানুষটা জীবনভর মানুষকে হাসিয়েছেন তিনিই বোধহয় বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন হাজারো কষ্ট। রিনির কথা আমাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে, এই রিনি ছিল শিবরামের প্রেমিকা। শিবরাম চক্রবর্তী তার 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা' বইয়ের অনেকটা অংশ জুড়ে এঁকেছিলেন রিনিকে। সন্দেশভর্তি মুখে প্রথম চুমুর মধ্য দিয়েই শিবরাম কি রিনির কাছে গোপনে পাচার করে দিয়েছিলেন প্রেমের নিষিদ্ধ ইস্তেহার? উত্তর অমিল, কিন্তু রিনি নিশ্চিতভাবে শিবরামের জীবনের অনেকখানি জুড়ে ছিল। সেই কিশোরবেলার পর যে বিচ্ছেদ ঘটেছিল, তা বহুদিন স্থায়ী হলেও অপেক্ষার অবসানও হয় একদিন। শিবরাম তখন স্বদেশি আন্দোলন করার জন্য কারাবরণ করছেন, সেই সময় আবার দেখা পান রিনির। কিন্তু ওই যে, তাঁর পায়ের তলায় সর্ষে! পুরোনো প্রেমিকাকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হবেন বা দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলবেন, তা যে শিবরামের পোষাবে না। তিনি যে ভিন্ন ধাতুতে গড়া। ফলশ্রুতি – অনিবার্য বিচ্ছেদ।
আরও পড়ুন
প্রেমেন্দ্র মিত্রের উপহার দেওয়া বই সটান বিক্রি করে দিয়েছিলেন শিবরাম
এমনই নানা রঙে রঙিন ছিল হাসির রাজার জীবন। অথচ তাঁরই জীবনের শেষ দিনগুলো চূড়ান্ত ফ্যাকাশে, রঙহীন। অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলেন বাথরুমে, অথচ দেখার কেউ নেই। যখন খবর পাওয়া গেল তখন বিশেষ কিছু করার নেই। অথচ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন - 'ফার্স্ট ক্লাস আছি।' হাসির রাজারা বোধহয় এমনই হন, দুঃখ রোগ ব্যাধি জ্বরা মৃত্যুভয় কোনো কিছুই ছুঁতে পারে না তাদের, সবকিছুর ঊর্ধ্বে তাঁরা।
তথ্যসূত্র -
১. 'ঈশ্বর পৃথিবী ভালোবাসা' - শিবরাম চক্রবর্তী
২. 'ভালোবাসা পৃথিবী ঈশ্বর' - শিবরাম চক্রবর্তী
৩. আনন্দবাজার পত্রিকা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মন্দির-মসজিদ নয়, সর্বধর্ম সমন্বয়ের জন্য পায়খানা বানানোর কথা লিখেছিলেন শিবরাম