ভারতীয় গ্রামগুলির একটি স্বতন্ত্রতা রয়েছে। এই স্বতন্ত্রতাই তাদের একে অপরের থেকে আলাদা করে। গ্রামগুলির সংস্কৃতিই মূল চালিকশক্তি। সংস্কৃতির জন্যই সেসব গ্রাম বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। সংস্কৃতির মধ্যে মিলেমিশে থাকে যাপন। অন্যদিকে, এই যাপনই সংস্কৃতির অংশ।
প্রাণীর যত্ন নেওয়া মানবিকতা। তবে, এ দেশে প্রাণী ঈশ্বরের অবতারও। তখন তার গুরুত্বও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। মহারাষ্ট্রের একটি গ্রামের কথা বলব। গ্রামে নাগ পঞ্চমীর উদযাপন হয় ঘটা করে। প্রত্যেক বাড়িতে রয়েছে সাপেদের জন্য ‘দেবস্থানম’ নামে আলাদা জায়গাও। বিড়াল, কুকুরের মতো পোষা প্রাণীকে পরিবারের বিশেষ সদস্য হিসেবে দেখা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য কোনো প্রাণী নয়, বিষাক্ত সাপ (Snakes)।
মহারাষ্ট্রের সোলাপুর জেলার মহোল তালুকের একটি গ্রাম শেতপাল (Shetpal)। কোড ৫৬২১৯২। সদর দফতর মহোল (তহসিলদার অফিস) থেকে ২৪ কিলোমিটার এবং জেলা সদর দফতর সোলাপুর থেকে ৬৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শেতপাল। গ্রামটি বিখ্যাত কেন, তা শুনলে অনেকেই তাজ্জব বনে যাবেন। এই গ্রামে ভুজঙ্গরা থাকে। আরেকটু সহজ করি। গ্রামটিতে একসঙ্গে থাকে সাপ ও মানুষ। শেতপাল গ্রামের মানুষ তাদের বাড়িতেই আশ্রয় দেয় বিষধর সাপদের। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। গ্রামের লোকেরা তাদের বাড়িতে শঙ্খচূড়ের মতো বিষাক্ত সাপেদের আশ্রয় দেয়। কিন্তু এই গ্রামে বসবাসকারী প্রতিটি পরিবার কেন এমন বিপদ নিয়ে খেলছে? এখানকার মানুষের কি ভয় নেই? সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে তারা কি ভয় পায় না?
শেতপাল গ্রামে সাপগুলি অন্যান্য পোষা প্রাণীর মতো স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বিষধর সাপ এমনভাবে ঘুরে বেড়ায় যেন পরিবারেরই সদস্য। মানুষও সাপের উপস্থিতি পাত্তা না দিয়ে যে যার মতো কাজ করে। আজ পর্যন্ত এই গ্রামে সাপের কামড়ে কেউ মারা যায়নি। সাপ কারোর ক্ষতিও করে না। শেতপাল গ্রামের মানুষ কখনো সাপ মারে না। এমনকী স্কুল ও অন্যান্য পাবলিক প্লেসেও সাপ ভয়ডরহীন ঘুরে বেড়ায়।
আরও পড়ুন
বসন্তকে স্বাগত জানায় জীবন্ত সাপেরা, নির্ধারণ করে কেমন যাবে নতুন বছর!
সাপেদের থাকার জন্য বাড়িগুলিতে তৈরি করা হয়েছে গর্ত। কেবল গ্রামের পুরনো বাড়িই নয়, নবনির্মিত বাড়িতেও সাপের জন্য গর্ত করার পরিকল্পনা থাকে প্রথম থেকেই। বাড়ির এককোণে করা হয় গর্ত। এই জায়গাটিই ‘দেবস্থানম’। বাড়ির এককোণের গর্ত। প্রায় শব্দহীন। সাপেদের জীবনযাপনের জন্য এক্কেবারে আদর্শ। কোবরার মতো বিষাক্ত সাপ সেখানে জিরিয়ে নেয়। দিন কাটায় বহাল তবিয়তে।
আরও পড়ুন
৭৫ হাজার সাপের উদ্ধারকর্তা মহারাষ্ট্রের ‘সর্পকন্যা’!
গ্রামের বাচ্চারা যখন স্কুলে যায়, তারা প্রায়ই সাপগুলোকে হাতের চারপাশে চুড়ি বা ব্রেসলেটের মতো জড়িয়ে রাখে। সাপ তো তাদের বন্ধু। ছোটবেলা থেকেই তারা সাপেদের সঙ্গে থাকছে। তাই এসব অতি সাধারণ। সয়ে গেছে। সাপেরাও দড়ির মতো জড়িয়ে থাকে তাদের বেড়ে ওঠায়। প্রায় ২৬০০ সাপের বাস শেতপালে। তবে গ্রামের মানুষ কবে থেকে বা কেন সাপের সঙ্গে বসবাস শুরু করেছিল, সে-সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
গ্রামটি পরিদর্শন করতে আসেন বহু পর্যটকই। তাদের হাতে থাকে সাপেদের ভেট— খাদ্যসামগ্রী। শেতপাল গ্রামের নিকটতম রেলওয়ে স্টেশন মোদানিম্ব। এখান থেকে লোকাল ট্রেনে শেতপাল গ্রামে পৌঁছানো যায়। কেউ বিমানবন্দর থেকে শেতপাল যেতে চাইলে নিকটতম বিমানবন্দর পুণে এয়ারপোর্ট। এখান থেকে ক্যাব সহজলভ্য।
গ্রামের মানুষ একেবারেই অন্যরকম। লোভহীন। ব্যবসায়িক কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই সাপ লালন-পালন তাদের। সাপ তাদের কাছে সুখ-সমৃদ্ধির প্রতীক। গ্রাম পরিদর্শনে আসা মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, কেন এখানে এত সাপ দেখা যায়? এই গ্রামের পরিবেশ সাপেদের অনুকূল। এখানকার আবহাওয়াও শুষ্ক। পাশাপাশি, গ্রামীণ এলাকা সমতল। এ ধরনের সমতল এলাকা সাপেদের আদর্শ।
অন্যদিকে, ধর্ম ও মানবতার মিশেল এই গ্রাম। পৌরাণিক কাহিনিতে শিবের গলায় সাপের অলংকার। তাই মহাদেবের সঙ্গে সাপও আরাধ্য। কথিত আছে, তক্ষক নাগের কামড়ে মৃত্যু হয় কুরুবংশীয় রাজা পরীক্ষিতের। ঘটনায় অশান্ত হয়ে ওঠেন রাজার পুত্র জনমেজয়। প্রতিজ্ঞা করেন, সর্পশূন্য করবেন পৃথিবী। শুরু করেন সর্পযজ্ঞ। তাঁর মন্ত্রোচ্চারণে কোটি সাপ যজ্ঞনলে ছাই। কাজেই জরৎকারু মুনি ও মনসাদেবীর পুত্র আস্তিক এই নিষ্ঠুর যজ্ঞ বন্ধ করতে জনমেজয়ের কাছে পৌঁছান। তাঁদের হস্তক্ষেপেই জনমেজয় বন্ধ করেন সর্পনিধন যজ্ঞ। শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমীতে বন্ধ হয়েছিল এই সর্পযজ্ঞ। সেই দিন থেকেই নাগ পঞ্চমী পুজোর চল। নাগ পঞ্চমী সর্পশক্তিকে লালন করার উৎসব। যদিও শিবের সঙ্গে উৎসবের তেমন সম্পর্ক নেই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উদযাপিত হয় ঐতিহ্যবাহী এই দিনটি। হাজার হাজার ভক্ত সাপপুজোয় মাতে। মহারাষ্ট্রের শেতপাল গ্রাম তার মধ্যে অন্যতম।
শেতপাল গ্রামবাসীরা এভাবেই ধর্ম, সংস্কৃতি এবং মানবতাকে ভারত তথা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছে।
Powered by Froala Editor