সত্তর দশক শেষ হয়ে আসছে। ভাসানের রাত। কলকাতা উত্তাল জনতায়, ঢাকের বাজনায়, অজস্র আমোদে। চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে ডিনার পার্টির জৌলুস, যার আলো পৌঁছয় না নিচু তলায়। রাতের জলসায় গান গেয়ে মাত করে দিয়েছেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সুদর্শন ‘তিনি’।... বয়স একটু বেশিই ঠেকছে, অম্লান তবু আইকনিক হাসি। জলসার অন্তে হাততালি পড়ছে বিপুল, শান্ত ভাবেই তিনি গাড়িতে উঠছেন। যেমনটা হিন্দি গীতিকার বলেছেন ‘আজ কি রাত’ -কিন্তু... কী হতে চলেছে?
বড়লোকদের পার্টি এখন তুঙ্গ ফর্মে। উজ্জ্বল নর নারী, হাসি ও গুঞ্জন, ঢালাও পানীয়। এই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেলেন এক শাদাচুলের পুরুষ। হাতের ‘কাজ’ সারতে বেশিক্ষণ লাগল না, আগন্তুক উধাও হলেন। ...এক মহিলা সহসা চিৎকার করেছেন! তাঁর নেকলেস কখন হাওয়া হয়ে গেছে। এভাবে আরো কেউ কেউ শোরগোল তুললেন। ...তৎক্ষণাৎ থানায় ছুট। মহিলার খোঁপায় একটা শাদা খাম কী করছে? ...কাগজের কাটিং দিয়ে বানানো একটি চিঠি - যেখানে ‘শুভ বিজয়া’র অভিবাদন জানিয়ে গেছে পলাতক ‘চোর’। পরিচয় হিসেবে জানিয়েছে – ‘ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার!’ এহেন মামলা নিয়ে অথৈ জলে কলকাতা পুলিশ।
হেমেন্দ্রকুমার রায় ‘আধুনিক রবিনহুড’ নামে একটি গল্প লেখেন (একই নামে একটি সংকলন বইও তাঁর বেরোয়) - যার প্লট, লেখক জানিয়েছেন, পশ্চিম দেশের এক ‘সত্য ঘটনা’ থেকে তুলে-নেওয়া। গল্পের নায়ক প্রাচীন শেরউড অরণ্যের মহৎ ‘দস্যু’কে অনুসরণ করে। তার কাজ ছিল বুর্জোয়াদের খানাপিনায় গিয়ে সম্পত্তি হরণ ক’রে গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া।... ‘শুভ বিজয়া’র রাতে, গরিব পল্লিতে কালো স্যুট-প্যান্ট পরা ফ্যাকাশে মুখের একজন হেঁটে আসছে। জীর্ণ বাড়িগুলি সারি বেঁধে আছে, খোলা জানলা দিয়ে কালো দস্তানা-পরা হাতে একটি ক’রে খাম ফেলে দিচ্ছে সে। ...টাকার নোট ও চিঠি দেখে বিস্ময়ের সীমা থাকছে না প্রাপকের। দয়ালু ‘দাতা’ ততক্ষণে মিশে গেছে গলির অন্তে ছমছমে আঁধারে।
আরও পড়ুন
‘শেষ পঞ্চাশ’ তৃতীয় পর্ব : বাঙালি শিল্পী ও ভ্যান গঘের প্রেত
সকলেই মনে হচ্ছে বুঝেছেন যে জলসার গায়ক ও ছদ্মবেশী ‘চোর’ এই দু’জন আসলে অভিন্ন। ... পশ্চিমি ‘সুপারহিরো’দের চিরচেনা ছক - নিপাট ভদ্রলোক পরিচয়ে এরা সামাজিক জীবন বজায় রাখেন এবং ছদ্মবেশ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে! ক্লার্ক কেন্ট যেমন সুপারম্যান, পিটার পার্কার – স্পাইডারম্যান; এবং ব্রুস ওয়েইন – দিনের বেলায় এক বিলাসী ধনকুবের আর রাতে গথাম শহরের পাহারাদার, যেমন ভেবেছিলেন কমিক-স্ট্রিপ লেখক বব কেন। ১৯৩৯ সালে ‘ডিটেকটিভ কমিক্স’-এর সাতাশ নম্বর সংখ্যায় উত্থিত হন ‘ব্যাটম্যান’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে একুশ শতাব্দী অবধি অনেক জল গড়িয়ে গেছে - তাঁর ক্যারিশমা আজও অটুট।
আরও পড়ুন
শেষ পঞ্চাশ দ্বিতীয় পর্ব : কল্পজগতের গুপ্তধন
রবি ঘোষ পরিচালিত ১৯৭৬ সালের ‘নিধিরাম সর্দার’ এরকমই একটি থ্রিলার, যেখানে আণ্ডারগ্রাউন্ড কলকাতার ‘দেখাশোনা’ ক’রে থাকে ‘নিধিরাম’। তার পার্সোনা কিছুটা রবিনহুডের এবং অনেকটাই মেলে ব্যাটম্যানের সঙ্গে। সে কোনও সাধারণ গোয়েন্দা নয়, সমাজে তার পরিচয় সুগায়ক ভদ্রজন হিসেবে। আবার সে-ই রাতের বেলা পালটে নেয় ভোল, গরিবের দেখভালের সাথে সাথে দুষ্কৃতি দমনের দায়ও সে নিয়েছে। কেউ বিপদে পড়লে ত্রাতার ভূমিকায় তাকেই দেখি, মাফিয়াদের দলের সুলুক সন্ধানও রাখে সে, ভিলেন (অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়)-কে সপাট লাথিতে শোয়ানো তার কাছে কঠিন কিছু নয়। খাতায় নাম উঠলেও কলকাতা পুলিশের সে ‘শত্রু’ নয় বরং বন্ধু। ...ফ্যাকাশে নির্বিকার মুখ, লম্বা নাক, শাদা চুল আর কালো দস্তানা-সহ ‘নিধিরাম’ মাফিয়াদের ত্রাস; তার ভূতুড়ে চলাফেরা কিংবা মেক-আপ এ সবই বাদুড়-মানুষের মতো তাকেও ক’রে তোলে অলীক, আতঙ্ককর, নিঃশব্দ অভিভাবক।
আরও পড়ুন
'শেষ পঞ্চাশ' প্রথম পর্ব: দ্বাদশ ব্যক্তি
ভোলা যায় না রূপসী ‘ভ্যাম্প’কে বন্দুক দেখিয়ে চলন্ত চারচাকায় জেরা করার সিকোয়েন্স অথবা গ্যাংলিডার পাকড়াশি-কে বেঁধে টেপরেকর্ডারে জবানবন্দি সমেত বসিয়ে রেখে-দেওয়ার নাটকীয় মুহুর্ত। সমাজের উঁচু তলা, নাইট ক্লাব, চটুল গান, মাস্তান ও তরুণী, মধ্যবিত্ত ক্লিশে (তানপুরা, আধুনিক গান, ঘরকন্না), পুলিশ স্টেশন, কাগজের আপিস, ক্লেদ, ভীরুতা, সাহস – কিছুই বাদ যায় না সত্তর দশকের এই ক্যালাইডোস্কোপে। ...পশ্চিমবাংলায় বসে আমরা মার্কিন দেশের গন্ধ পাই, টালিগঞ্জ আর হলিউডের বর্ডারটি ঝাপসা ক’রে দেয় পাপনগরীর রগরগে, বিশ্বস্ত ডিটেল।
স্বর্ণযুগ অস্ত হব-হব সময়ে বাংলা সিনেমার অপ্রত্যাশিত অর্জন হিসেবে ‘নিধিরাম সর্দার’ আমাদের আর্কাইভের বিশেষ ভল্ট-এ থেকে যাবে।
Powered by Froala Editor