দুর্ঘটনা যেন নিত্যসঙ্গী তাঁর। প্রায়ই জড়িয়ে পড়তেন মানুষের বিপদের মধ্যে। আর প্রতিবারই ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হতেন তিনি। হয়তো সেই মুহূর্তে, তাঁর সেখানে উপস্থিত থাকার কথাই নয়। তবু এক আশ্চর্য জাদুবলে উপস্থিত থাকেন দুর্ঘটনাস্থলে। একা হাতে বাঁচিয়েছিলেন বহু মানুষের প্রাণ। তার ফলে বারবার বাধার সম্মুখীন হয়েছে সাঁতারু জীবন। দাবিদার ছিলেন যে সাফল্যের, কোনোদিনই সেই উচ্চতায় পৌঁছোতে পারেননি সাভার্স কারাপেতিয়ান (Shavarsh Karapetyan)। তাতে অবশ্য আক্ষেপ নেই কোনো। মানুষের জীবন বাঁচানোর কাছে তুচ্ছ মনে করেছেন সাঁতারু জীবনের সাফল্যকে।
১৯৭৪ সালের ঘটনা। সাভার্সের বয়স তখন মাত্র কুড়ি। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, বা আজকের আর্মেনিয়ার প্রতিশ্রুতিমান সাঁতারু হিসেবে তখনই বেশ নামডাক তাঁর। এছাড়াও ছিল অটো-মেকানিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি। সেবার জন্মস্থান কিরোভাকান (বর্তমান নাম ভানাডজোর) থেকে বাসে করে যাচ্ছেন দূরের এক শহরে ট্রেনিংয়ের জন্য। সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা, দুপাশে ঘন সবুজের ছায়া। দেখতে দেখতে মোহিত হয়ে গেছিলেন সাভার্স। হুঁশ ফিরল গাড়ির তীব্র বিকট শব্দে। পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল বাসটি। কী সমস্যা দেখতে ড্রাইভার নেমে গেলেন গাড়ি থেকে, খেয়ালই করলেন না যে ইঞ্জিন চালু রয়েছে। আচমকা খাদের দিকে ঢলে পড়তে লাগল বাসটি। মৃত্যু প্রায় অনিবার্য, আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল যাত্রীরা। কিন্তু সেই মুহূর্তেই সবকটি ইন্দ্রিয় যেন সজাগ হয়ে উঠল সাভার্সের। গাড়ির পিছন সিট থেকে দৌড়ে গিয়ে কোনোরকমে বন্ধ করলেন ইঞ্জিন। সমস্যা মিটল না তাতেও। ওই পরিস্থিতিতেই মাথা ঠান্ডা রেখে কাজে লাগালেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বিদ্যা। থেমে গেল বাসের গতি। প্রাণে বেঁচে গেল সাভার্স সমেত আরো পঞ্চাশজন যাত্রী।
যদিও এই ঘটনা ছিল সূত্রপাত মাত্র। এর পরের ঘটনায় সম্পূর্ণরূপে বদলে যায় সাভার্সের জীবন। বাস দুর্ঘটনার পরে তিনি যুক্ত ছিলেন সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের সাঁতার প্রতিযোগিতায় গড়লেন একাধিক রেকর্ড। ইতিমধ্যেই ৩৭টি স্বর্ণপদক তাঁর ঝুলিতে। স্বপ্ন দেখছেন আরো অনেক দূর যাওয়ার। ১৯৭৬-এ ফিরে আসেন দেশের বাড়িতে। অভ্যাসমতো ভাই কামোর সঙ্গে রোজই যেতেন কাছের ইয়েরেভান লেকে সাঁতার কাটতে। ১৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে ২০ কিলোমিটার সাঁতারের পর শুনতে পেলেন এক ভয়ঙ্কর শব্দ। কুয়াশা ঢাকা সন্ধ্যার আধো-অন্ধকারে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে আসছে একটি বাসের অবয়ব। অস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে মানুষের আর্তনাদ। দুবছর আগের স্মৃতি যেন মাথার মধ্যে খেলে গেল চুপিসারে। সঙ্গে সঙ্গে সাঁতার কেটে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। ততক্ষণে ৯২ জন যাত্রীসমেত অনেকটাই ডুবে গেছে বাসটি। একা হাতে উদ্ধার করলেন ৪৬ জনকে। কিন্তু প্রায় ২০ জন তখন জলের তলায়। ২৫ সেকেন্ডের এক-একটি ডুবে তুলে নিয়ে এলেন প্রত্যেককে। যদিও বাঁচানো গেল না সবাইকে। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন কয়েকজন।
আর সাভার্সের কী হল? ভয়ানক ঠান্ডায় জলে ডুবে থাকার ফলে ৪৫ দিন ধরে চলল তাঁর চিকিৎসা। বাসের কাচের জানলা ভাঙতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল শরীরের বহু অংশ। আক্রান্ত হয়েছিলেন নিউমোনিয়া আর সেপসিসে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি ফিরলেন হৃদপিণ্ডে চিরকালীন সংক্রমণ নিয়ে। বন্ধ হয়ে গেল সাঁতার। জীবন থেকে বহু দূরে চলে গেল জলের তলায় রাজত্ব করার সমস্ত স্বপ্ন। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, দীর্ঘদিন চাপা পড়ে রইল বাস দুর্ঘটনায় তাঁর অতিমানবিক কৃতিত্বের কথা। স্থানীয় প্রশাসনের অফিসে বন্ধ হয়ে রইল দুর্ঘটনার সমস্ত ছবি ও তাঁর উপস্থিতি। ঘটনা জানাজানি হতে লেগে গেল আরো দুবছর। অবশেষে বীরত্বের প্রাপ্যসম্মান পেলেন ১৯৮২ সালে এসে। খবরের কাগজে তাঁর সাহসিকতার কথা ছাপা হতেই সারা দেশের প্রায় ৬০০০০ মানুষ চিঠি পাঠিয়ে ধন্যবাদ জানাল সাভার্সকে।
আরও পড়ুন
পক্ষাঘাত থেকে ফিরে সাঁতারের প্রশিক্ষক, অনুপ্রেরণার অন্য নাম ক্লিফ ডেভরিস
তারপরে জীবন হয়ে পড়ল বড়ো স্থবির। জলে না নামতে পারলেও, সাঁতার প্রশিক্ষণ দিয়ে কেটে গেল কয়েকটি বছর। ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ফের নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হল তাঁকে। এবার জল নয়, আগুন। আর্মেনিয়ার যে কেন্দ্রে তিনি সাঁতার শেখাতেন, তার কিছু দূরের একটি বাড়িতে লেগে যায় আগুন। দীর্ঘ চেষ্টাতে আগুনের লেলিহান শিখা নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও বাড়ির মধ্যে বন্দি রয়েছে বহু মানুষ। দমকলের কর্মীদের সঙ্গে তিনিও ঝাঁপিয়ে পড়লেন উদ্ধারকার্যে। আর এবারও তাঁর ঠিকানা হল হাসপাতালে। শরীরের বেশ কিছু অংশ পুড়ে যায় মারাত্মকভাবে।
আরও পড়ুন
মায়ানমার ‘গণহত্যাকারী’, অলিম্পিকে বহিষ্কারের দাবি সে-দেশেরই সাঁতারুর
তার পরের বছরই এক বিরল সম্মান অপেক্ষা করেছিল তাঁর জন্য। ১৯৭৮ সালে বিজ্ঞানী নিকোলাই চেরনিখ দ্বারা আবিষ্কৃত একটি গ্রহাণুর নাম রাখা হয় ‘৩০২৭ সাভার্স’। ২০১৪ সালে রাশিয়ার শীতকালীন অলিম্পিকের মশাল বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। সাঁতারের মাধ্যমে সাফল্যের যে শিখরে উঠতে চেয়েছিলেন তিনি, তা হয়তো অপূর্ণ থেকে গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর নাম পৌঁছে গেছে মহাকাশে, মানববিশ্ব থেকে অনেক অনেক উঁচুতে।
Powered by Froala Editor