বাবা মুঙ্গেরের নামকরা উকিল। খ্যাতি, প্রতিপত্তি সবই করেছেন জীবনে। দিব্যি কাটছিল জীবন। কিন্তু তিনিই বা আর কতদিন! তাঁর ইচ্ছা, ছেলে এসে ওকালতির হাত ধরুক। বাবার মতোই জীবনটা পোক্ত করুক। এদিকে ছেলে পড়ল মহা মুশকিলে। বাড়ির কথা, আপনজনের কথা; নাকি নিজের মনের ইচ্ছা? কলেজজীবনে এসে সাহিত্যকে ভালোবেসেছেন যে! এমন ‘বিষয়বুদ্ধির চিন্তা’ কি তাঁর করা সম্ভব? কিন্তু বাবার যে ইচ্ছে! অগত্যা শুরু করতেই হল ওকালতি। ভেবেছিলেন, উকিল হয়েও সাহিত্যচর্চা করে যাবেন। ততদিনে বইও বেরিয়ে গেছে একটি। গল্প, উপন্যাসও প্রকাশিত হচ্ছে নানা পত্রিকায়। না, ওকালতি করে সাহিত্যসাধনা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে সম্ভব নয়। নিজের মনের ঠিকানাকেই বেছে নিলেন শেষ পর্যন্ত। রোজগার তো থাকবেই, আর সেটা করবেন লিখেই।
আশ্চর্যের বিষয়, অনেকের মতো শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রথমে কবিতার প্রেমে পড়েন। নিজের সমস্ত অনুভূতি উজাড় করে দিচ্ছেন সেখানে। প্রথম বই ‘যৌবনস্মৃতি’ও ছিল কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু সেসব কিছু পাঠকজগত মনে রাখেনি। শরদিন্দু অমর হয়েছেন তাঁর অবিস্মরণীয় সব গল্প, উপন্যাসে। শুধু ‘ব্যোমকেশ’-কে দিয়েই গোয়েন্দা সাহিত্যের ধারায় নতুন জোয়ার আনলেন। তারপর ঐতিহাসিক উপন্যাস, সামাজিক, রোম্যান্টিক, ভৌতিক— সব রকম লেখাই তাঁর কলম থেকে বেরিয়েছে। বাংলার আপামর পাঠকও পেয়ে গেলেন তাঁর আপন মানুষটিকে। ওকালতি ছাড়ার পরই আগমন ঘটল ব্যোমকেশের। তারপর যত দিন গেছে, সাহিত্য জগতে ক্রমশ নিজের স্থানটি দৃঢ় হয়েছে শরদিন্দু’র।
সংসারে অভাব সেভাবে ছিল না প্রথমে। বাবা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এত বড়ো একজন উকিল, মক্কেলের আনাগোনা লেগেই থাকত। মুঙ্গেরে যথেষ্ট নামডাক। আর শরদিন্দুও লিখে যা রোজগার করছেন, তা চালানোর জন্য ঠিকঠাক। একটা সময় মনে হচ্ছিল, গাড়িটা ঠিক দিকেই এগোচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় খানাখন্দ আসবে না, তা কী হয়! সবার দিনও যে একরকম থাকে না। তিরিশের দশকে তারাভূষণের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে হাজির হল ১৯৩৪-এর ভূমিকম্প। মুঙ্গেরের বাড়িটা ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল। সেসব নিজের চোখে দেখেছিলেন শরদিন্দু। তখন পরিবারও বেড়েছে— স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি এবং আরও সবাই। তাঁর নিজেরও রোজগার আছে; কিন্তু সেই ভরসায় গোটা সংসার চালানো তো যায় না। প্রয়োজন পড়ল টাকার। শরদিন্দু ভেবেছিলেন লিখেই জীবনটা কাটাবেন, এটাই তাঁর একমাত্র পথ হবে। জীবন এক কঠিন পরিস্থিতির সামনে এনে দাঁড় করাল। এবার যে চাকরি খুঁজতেই হবে…
এমন সময় অভাবনীয় সুযোগ চলে এল। হিমাংশু রায় তখন বম্বে টকিজে। মুম্বাইতে বাঙালি চিত্রনাট্যকার তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই বাংলায় খোঁজ চালালেন তিনি। অনেকের কাছে গেলেনও, কিন্তু ব্যর্থ সেই প্রয়াস। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ফেরত পাঠিয়ে দিলেন সেই ডাক। কী করবেন এবার? এমন সময় তাঁর শ্যালক এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের চোখ পড়ল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর। চিঠি লিখলেন তাঁকে। শরদিন্দু দেখলেন, চাকরিটা তাঁর একান্ত প্রয়োজন। আর লেখাও তো ছাড়তে হবে না। বম্বে টকিজে গিয়ে সেই লেখারই তো কাজ করবেন। ব্যস, ১৯৩৮ সালে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে রওনা হলেন মুম্বাই। শুরু হবে এক নতুন অধ্যায়…
‘ভাবী’, ‘বচন’, ‘আজাদ’, ‘দুর্গা’-সহ সাতটি ছবিতে চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করলেন তিনি। ‘বিষের ধোঁয়া’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ‘ভাবী’ তখন রীতিমতো সুপারহিট। মুম্বাইয়ের মালাডে অঞ্চলের বাগানঘেরা বাড়িতে থাকছেন তিনি। আড্ডায় মেতে উঠেছেন; সঙ্গী শচীন দেববর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষেরা। তৈরি করছেন নতুন খেলা ‘অন্তাক্ষরী’। তিন বছর পর বম্বে টকিজের চুক্তি শেষ হলে যোগ দিলেন আচারিয়া আর্ট প্রোডাকশনে। সেখানেও কাজ করলেন। তারপর ফ্রিল্যান্স কাজও করতে লাগলেন। কখনও উপন্যাস-গল্প থেকে চিত্রনাট্য, কখনও আবার চিত্রনাট্য পরবর্তীতে রূপ নিচ্ছে গল্পে। এইভাবেই ‘যুগে যুগে’-র চিত্রনাট্য রূপ পেয়েছিল ‘রাজদ্রোহী’ উপন্যাসের।
একভাবে দেখতে গেলে, একটু যেন আর্থিকভাবে থিতু হয়েছেন শরদিন্দু। পরিবার নিয়ে মুম্বাইতে ভালোভাবেই নিজের বাড়িতে রয়েছেন। কাজও করছেন। কিন্তু তাঁর নিজের লেখা কোথায়? তাঁর ডায়েরির পাতায় সেইসব দিনের হতাশা যেন ঠিকরে বেরিয়েছিল। ‘ব্যোমকেশ’ থেমে আছে। অন্যান্য গল্পও খুব বেশি যে লেখা হচ্ছে, তাও নয়। এদিকে সিনেমায় কাজের সূত্রে বুঝলেন, এখানে কেবল এবং কেবলই ‘টাকা কথা বলে’। অনেক সময় তাঁর লেখা গল্প প্রযোজক আমূল বদলে দিলেন। ক্রমশ আশা হারাচ্ছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। লিখছেন তো বটে, সেই লিখেই রোজগার করছেন; কিন্তু এই জীবন আর ভালো লাগছিল না। সেরকম নামী জায়গাও তো পাননি এখানে। মন বারবার চাইছিল ফিরে যেতে সাহিত্যের মধ্যে।
আরও পড়ুন
ব্যোমকেশের ‘মেস’ থেকে জীবনানন্দের আস্তানা, বন্ধের মুখে শতাব্দীপ্রাচীন প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং?
জীবন বড়ো আকস্মিক। আমরা সকলেই সেই আকস্মিকতার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। ঝড় আসে, আবার চলেও যায়। শরদিন্দু’র বড়ো ছেলে চাকরিতে প্রবেশ করলেন। এবার কি তাহলে ছুটি নেবেন চিত্রনাট্যের জগত থেকে? ফিরে আসবেন সাহিত্যজগতে? ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনিও জানালেন, সবার দায়িত্ব নিতে সক্ষম। একেবারে ঝাড়া হাত-পা হলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। মুম্বাইয়ের সিনেমার জগতকে বিদায় জানালেন চিরকালের মতো। চলে এলেন পুনেতে, নিজের নতুন বাড়ি ‘মিথিলা’য়। ১৯৫১ সালে ‘চিত্রচোর’-এর হাত ধরে আবারও ফিরল ব্যোমকেশ বক্সী। ফিরল ঐতিহাসিক উপন্যাস। ফিরলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়…
তথ্যসূত্র—
১) ‘শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়’, সব বাংলায়
২) ‘গোয়েন্দা কাহিনিকে সামাজিক উপন্যাসে উন্নীত করেছিলেন’, জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘বোম্বাইয়ের ব্যোমকেশ, অচেনা শরদিন্দু এস ব্যানার্জি’, গৌতম চক্রবর্তী, আনন্দবাজার পত্রিকা
আরও পড়ুন
টেলিভিশনে ব্যোমকেশ; রাজিত কাপুরকে সঙ্গী করে হিন্দিতেই বাজিমাত বাসু চট্টোপাধ্যায়ের
Powered by Froala Editor