“সময়টা আশি থেকে তিরাশি সাল। তখন মহিলাদের অবমাননাকর বেশ কিছু ঘটনা ঘটছিল। যেটা হয়তো দ্রৌপদীর অপমানের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। সেইজন্যই হয়তো আমার মনে হয়েছিল দ্রৌপদীর চরিত্রটা নিয়েই আমি কাজ করব।”
বলছিলেন শাঁওলী মিত্র, যাঁর পরিচয় দেওয়াটা বাতুলতা এবং খানিক দুরূহও বটে। কারণ, নাট্য নির্দেশনা, নাট্যরচনাই হোক বা অভিনয়— তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায় বাংলা নাটকের পরিমণ্ডল। সম্প্রতি এসপিসি ক্রাফটের একটি অনুষ্ঠানে কালজয়ী নাটক ‘নাথবতী অনাথবৎ’-এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়েই তিনি তুলে আনেন নাটকটির জন্মমুহূর্তের কথা। আজকের প্রজন্মের কজনেরই বা সুযোগ হয়েছে মঞ্চে এই নাটকটিকে চাক্ষুষ করার? শুধু সেই নাটকের ক্যামেরাবন্দি টুকরো কিছু বিক্ষিপ্তাংশ দেখলেও শিহরিত হতে হয় আজও। সেখানে তিনি কথক থেকে হয়ে উঠছেন কর্ণ। আবার কখনও দুর্যোধন, যুধিষ্ঠির কিংবা দ্রৌপদী। শুধু বদলে যাচ্ছে কণ্ঠস্বর। আর চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকগুলিকে।
শুধু ‘নাথবতী অনাথবৎ’-ই নয়, বিভিন্ন নাটকের মধ্যে দিয়েই যেন আঘাত হেনেছেন তিনি। অভিনয়ই হয়ে উঠেছে তাঁর প্রতিবাদের শাণিত হাতিয়ার। আর তার প্রেক্ষাপট নানা পৌরাণিক কাহিনী। কখনও মহাভারত আবার কখনও তা রামায়ণ। বছর দুয়েক আগের কথা। ২০১৯ সাল। পাঠ-নাটকের আকারেই উপস্থাপন করেছিলেন আরও এক মহাকাব্যিক নাট্যচরিত্র। মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘সীতা কথা’। যে উপস্থাপনা নীরবেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায় গোটা সমাজকে। দর্শক-শ্রোতাদেরও ঠেলে দেয় এক লজ্জাবোধের দিকেই।
শম্ভু মিত্রের ‘পুতুলখেলা’ নাটকটির উপস্থাপনাতেও যেন প্রতিফলিত হয়েছে সেই সমাজের ছবিই। হেনরিক ইবসেনের ‘ডলস হাউস’-এর অবলম্বনেই নাটকটি রচনা করেছিলেন শম্ভু মিত্র। আর মঞ্চে নোরার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শাঁওলি। নারীবাদ নয়, বরং লিঙ্গ বৈষম্যই প্রাধান্য পেয়েছে সেখানে। একজন নারী কিংবা পুরুষের চরিত্র ঠিক কেমন হবে— তা ঠিক করে দেয় সমাজই। সেই সামাজিক বেড়াজাল, লিঙ্গ রাজনীতিকেই ফুটিয়ে তুলেছিলেন শাঁওলি।
কিন্তু শুধু নাটক তৈরির সময়ই কি তাঁকে ভাবিয়েছে তৎকালীন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক প্রেক্ষাপট? না। কথায় কথায় শাঁওলি তুলে আনলেন ‘কথা অমৃতসমান’ নাটকটির কথা, “এই নাটকটি যখন প্রথম আমি করি সেটা ৯০ সাল। তখনও বাবরি মসজিদের ঘটনাটি হয়নি। ’৯২ সালের ডিসেম্বরের পর যখন পুনরায় এই নাটকটি মঞ্চস্থ করতে গেলাম, তখন দেখলাম আমি পুরনো সংলাপে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছি না। আমি শুরুটা আবার নতুন করে লিখলাম বাবরি মসজিদের ঘটনাকে মাথায় রেখে।”
এই নাট্যরূপের পরিবর্তন আর কিছুই নয়। তা আসলে ধর্মকে সামনে রেখে আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই তো রুখে দাঁড়ানো। আর প্রতিবাদের কথা যদি বলতেই হয় রাজনীতি, সমাজনীতির পাশাপাশি তাহলে পরিবেশের কথা উঠে আসাও আবশ্যিক। সেই জায়গাটাতেও বাদ যাননি শাঁওলি। বলতে গেলে তাঁর হাত ধরে বাংলা নাটকে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল পরিবেশ সচেতনতার। ‘ত্রিংশ শতাব্দী’-তে যেমন হিরোশিমা, আণবিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা উঠে এসেছে; তেমনই ‘বিতত বিতংস’-তেও উঠে এসেছে পরিবেশ-সংক্রান্ত একাধিক বিষয়। নাটকটির স্রষ্টা না হয়েও তার রচনার কাজে ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে ছিলেন শাঁওলি। “সেসময় নাটকটির প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য, তখনকার সময়কে বোঝার জন্য বহু গবেষক, ভূবিজ্ঞানী, পশুবিজ্ঞানীদের কাছে গেছি। বিষয়টা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছি নিজেও। বিভিন্ন জায়গায় ব্লাস্ট করে কারখানা তৈরিতে কী ক্ষতি হচ্ছে, সেগুলোও জানার জন্য কোল ইন্ডিয়ার কাছেও দ্বারস্থ হয়েছিলাম আমি”, স্মৃতিচারণ করছিলেন শাঁওলি মিত্র।
শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল সৎনাট্যের ধারা। সেই ধারার ধারক ও বাহক তো শাঁওলি মিত্রই। এই সৎনাট্যের প্রাণ আবর্তিত হয় অভিনয়ের সততাকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু শুধুই কি তাই? নাট্য রচনার মধ্যে দিয়ে সমসাময়িকতা এবং পরিপার্শ্বে ঘটে চলা ঘটনার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠাও কি সেই সততারই অভিপ্রকাশ নয়? শাঁওলি মিত্র’র সেই প্রতিবাদী সত্তার মধ্যে দিয়েও যে বেঁচে রয়েছে সৎনাট্য, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই…
Powered by Froala Editor