স্কুল-জীবনে মাস্টারমশাইয়ের কানমলা কমবেশি সবাই-ই খেয়েছে। অন্তত যারা এখন বেশ বড়ো হয়ে, বুড়ো হব-হব করছে, তারা তো খেয়েইছে। আজকাল অবশ্য স্কুলছাত্রেরা সে স্বাদ থেকে বঞ্চিত। বাইরের নিয়ম কড়া হয়েছে। কানমলা তো দূরের কথা। বকাঝকার পরিধিও সুনির্দিষ্ট । তার ফলাফল যে কী, তা স্কুলশিক্ষকরা খুব ভালোই বোঝেন। তা শান্তিনিকেতন আশ্রমে কানমলার একটি কাহিনি জনশ্রুতির মতোই ঘোরাফেরা করত। প্রমথনাথ বিশী শান্তিনিকেতনের স্মৃতিচারণায় লিখছেন সে-কথা।
আশ্রমের সেটা প্রথম যুগ। শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন স্বনামধন্য ক্ষিতিমোহন সেন। সুদূর চাম্বা রাজ্য থেকে তাঁর আগমন। মহাজ্ঞানী মহাজন। বাহুবলেও বেশ 'মহান'। কিন্তু ছাত্রদের তখনও সেই মহাজ্ঞানের ও বলের গভীরতা উপলব্ধির বয়স হয়নি। নতুন শিক্ষক পেয়ে তারা খানিক বাজিয়েই দেখতে চায়। আশ্রমে জুতো পরার রেওয়াজ নাকি তখন ছিল না। অসুখবিসুখ করলে অবশ্য অন্য কথা। ক্ষিতিমোহন সেনের ক্লাসে এক ছাত্র তার জুতোজোড়া ক্লাসের মধ্যে এনে রাখে। শিক্ষক নির্দেশ দেন, জুতো ক্লাসের বাইরে রাখার। কিন্তু বেয়াদব ছাত্র জানায়, আশ্রমে নাকি ক্লাসের ভিতরেই জুতো রাখার নিয়ম। ক্ষিতিমোহন সেন সাবধান করেন- "ওরকম অবাধ্যতা করলে মার খাবে..."। ছাত্রটিও ছাড়ার পাত্র নয়। উত্তর দেয়, আশ্রমে প্রহার নিষিদ্ধ। এবার ক্ষিতিমোহনবাবুর পালা। ছাত্রটিকে কান ধরে শূন্যে তুলে জানিয়ে দেন, সে এখন আশ্রমের বাইরে। তারপর চলে বেশকিছু চড়চাপ। এইভাবেই নাকি ছাত্রমহলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন।
এখানেই শেষ নয়। ক্ষিতিমোহন সেন যখন আশ্রমের সর্বাধ্যক্ষ তখন তার ঘরে ছাত্রদের ডাক পড়লেই, তাদের প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার জোগাড় হত। ছাত্রেরা বেশ কিছু গরম জামা কোট পরেটরে তাঁর সামনে গিয়ে হাজির। সেই যাত্রাকে ছাত্রেরা নাম দিয়েছিল 'দার্জিলিং-যাত্রা'। কী মোক্ষম নামকরণ!
আশ্রমে প্রহারের নিয়ম না-থাকলেও, ইতিউতি প্রহার চলতই। জগদানন্দ রায় নাকি একবার এক ছাত্রকে মেরে এমনি কষ্ট পেয়েছিলেন, যে তাকে ডেকে বিস্কুট খাইয়েছিলেন। তারপর থেকে ছাত্রেরা তাঁর হাতের অতি উপাদেয় মার খেতে চাইত, বিস্কুটের আশায়। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য। জগদানন্দবাবু প্রহারে ইতি টানলেন।
তবে, এই 'মারের' পরেও কিন্তু সেদিনের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে ছেদ পড়েনি। ছাত্র-পেটানো নিশ্চয়ই শিক্ষাদানের অন্যতম মাধ্যম নয়। কিন্তু আজকালকার দিনে যেভাবে বাইরের নিয়ম দিয়ে, আইনকানুন দিয়ে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ককে বাঁধা হয়েছে - তাতে শিক্ষার খোলা মাঠটাই গেছে হারিয়ে। স্কুলে-পড়া মানে কোনোভাবে সিলেবাস পড়ে, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটাও ঠিক ওইটুকু গণ্ডিতে আটকা। ফলে না তাতে ছাত্রের মূল্যবোধ তৈরি হয়, ভুল-ঠিক বিচারের ক্ষমতাও তৈরি হয় না৷ ক্ষিতিমোহন সেনেরা যত বড়ো শিক্ষকই হোন না কেন, এ-যুগে জন্মালে নিশ্চিত হাজতবাস করতে হত।