সাত দশক ধরে আয়ুধ সরবরাহ করেছেন বাঙালিকে

'শঙ্খ ঘোষের নাম শোনেনি এমন কেউ / তোমায় যদি প্রোপোজ করে, কী করবে?' লিখেছিলেন কবি শ্রীজাত। না, এরকম কোনো বিড়ম্বনার সামনে ব্যক্তিগতভাবে পড়তে হয়নি। তবে, বাংলা কবিতাকে পাঁজরে দাঁড়ের শব্দের মতো বয়ে নিয়ে চলেছি কতিপয় এই আমরা যারা, কখনো শঙ্খ ঘোষের কোনো বই প্রিয়জনকে উপহার দিইনি এমনটা সম্ভবত ঘটেনি। আমি নিজে যেমন উপহার পেয়েছি তাঁর কবিতার বই, তেমনই একাধিকবার উপহার দিয়েছি 'কবিতার মুহূর্ত'। কবিতা তো বটেই, সাহিত্য প্রসঙ্গ কিংবা জীবনের অম্লমধুর চালচিত্রের কথা কেমন আটপৌরে অথচ ঋদ্ধ ও স্বাদু ভাষায় বুনতে হয় নানান স্বাদের গদ্যলেখায় তার উদাহরণ ছড়ানো। আশ্চর্য লাগে যে কীভাবে যেমনভাবে বাস্তবে কথা বলেন তিনি তেমনভাবেই গড়ে ওঠে তাঁর গদ্য। বাক্যগঠন একইরকম শান্ত ও লিরিকাল, কী জার্নালধর্মী লেখায় কী সাহিত্যের আলোচনায়। শিখতে হয় কীভাবে লাটাই থেকে সুতো ছাড়ার মতো আস্তে আস্তে কোনো একটি চিন্তার পূর্ণ অবয়বের দিকে যেতে হয়, তাড়াহুড়ো করলে চলে না।

কবি শঙ্খ ঘোষের প্রতি মিষ্টি একটা রাগ ছিল আমার। লেখালিখির শুরুর দিকে কেন যে পড়তে গেছিলাম তাঁর 'গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ'! সেইসব কুহকভরা লিরিকে দীর্ঘকাল মজেছি এমন যে সম্বিত ফিরতে তাঁর গাঢ় চিত্রকল্প আর অমোঘ অক্ষরবৃত্তের জাদুর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ছটফট করেছিও কত! কারণ, যত সামান্যই হই, আটকে তো আমি যাবো না, পাল্টাবই। 

দীর্ঘ দীর্ঘদিন আবার তাঁরই শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় লেখা স্বগতোক্তি এই অক্ষম কবিতাপ্রয়াসীকে সাহস দিয়েছে - 'সাহিত্যে প্রগলভতার স্থান নেই। তাই, কম লিখি বলে আমার ভয় হয় না।' শঙ্খবাবুর লেখায় কিংবা জীবনযাপনে এই পরিমিতিবোধের কথা এতদিনে প্রবাদপ্রতিম। 'গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ' এবং তার আশেপাশে লেখা কিংবদন্তি কবিতাবইগুলিতে গ্রন্থিত একটি কবিতাও তাই বর্জনযোগ্য নয়। কবিতা ভালো মুখস্থ রাখতে পারি না, তবু অদ্ভুতভাবে সম্পূর্ণ স্মৃতিতে থেকে যায় এই অমিতসম্ভব বইয়ের প্রবেশক কবিতাটা, তুলে দিই-

'কে আমাকে ডাকল, আমি জেগে উঠলাম
অন্ধ এই অন্ধকারে শব্দ হলো ফুল
রক্তমুখী, বুকের ওপর দুলছিল তার রঙ
ধাতুর মতো, কে আমাকে আনল গুহার তলে।
পাথরগুলি বিস্ফার চায়, তারার মতো জ্বলে,
দুয়ের মধ্যে শূন্য আসে বিশ্বভুবনজোড়া
কে আমাকে ডাকল সেই শূন্যে ঝাঁপ দিতে
রক্তমুখী চূড়ার থেকে সজল পৃথিবীতে।'

আরও পড়ুন
বঙ্গসমাজের শেষ আলোকবর্তিকা

রিচার্ড ইয়ান্টুর-এর অনুবাদ করা বইয়ের আখ্যাপত্র

 

আরও পড়ুন
পাঠকের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া ফুরোবে না কোনোদিন

ছন্দ বাংলা উচ্চারণকে কত মাধুর্য দিতে পারে, কীরকম গানের মতো হয়ে ওঠে আমাদের বাংলা কবিতা, তা যে ক'জন কবির কলমে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার অন্যতম প্রধান শঙ্খ ঘোষ। 

আরও পড়ুন
বাংলা সাহিত্যজগতে নক্ষত্রপতন, প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ

কবিতাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে, সন্দর্ভ রেখেছিলেন ইংরেজ কবিচূড়ামণি ওয়ার্ডসওয়ার্থ। তবে, সে কাজের বাস্তবায়ন তাঁর কবিতায় বড়ো একটা ধরা কিন্তু পড়ে না। অথচ শঙ্খ ঘোষ, বেশিরভাগ সাহিত্যপ্রয়াসী যাকে ডাকলেন শঙ্খবাবু কিংবা স্যার অভিধায় - কবিদের জগতে সর্বজনীন 'দা' এক্ষেত্রে 'শঙ্খদা' ডাকার লোক আজও হাতে গোনাই, এহেন শঙ্খবাবু তাঁর অধ্যাপনার খ্যাতি, পাণ্ডিত্য, শীলিত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও কবিতায় প্রায় গত সত্তর বছর ধরে তুলে আনলেন এমন সব চলতি জনপ্রিয় লব্জ যা মিছিলে স্লোগানে কিংবা প্রতিবেদনে কিংবা বক্তৃতায়, সাহিত্য আড্ডায় বারংবার ব্যবহৃত হল একপ্রকার  আয়ুধের মতো। 'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে', 'পুলিশ কখনো কোনো অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ', 'দুটোই মাত্র সম্প্রদায় / নির্বোধ আর বুদ্ধিমান', 'কথা তবু থেকে যায় কথার মনেই / কঠোর বিকল্পের পরিশ্রম নেই', 'চরিত্রই নেই যার তার আবার ধর্ষণ কোথায়'  - ইত্যাদি আরও কত! ইমার্জেন্সির সময়ে তাঁর অবস্থান আজও এক মাইলফলকের মতো। আগুনঝরা সত্তর ও তার স্বজনহারানো বেদনা কী সংহতভাবে ধরা পড়ে এই ছোট্ট কবিতায় -

'ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায়
দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ
তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই
    তোমার ছিন্ন শির, তিমির।'

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বারংবার অবস্থান জানান দিয়েছেন তিনি, সামাজিক অবক্ষয় কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে তাঁর কাছ থেকে স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া মিলেছে। সারস্বত সমাজের এক বিরাট ভরসাস্থল হয়ে থেকেছেন সাতটি দশক জুড়ে তিনি। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট, তৃণমূল, বিজেপি - প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের চ্যুতির বিপক্ষে কবিতা আছে তাঁর। সশরীরে রাস্তায় নেমেছেন, ত্রাণ নিয়ে গেছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগে, বস্তুত বেঁধে বেঁধে থাকবার  ডাক দিয়েছেন অগুনতি। অনুজ কবিদের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন প্রত্যেকবার, এরকম কত ঘটনাই না কবিমহলে ভেসে বেড়ায়! মৃদু অনুযোগও কি নেই কারও কারও? এমন মাপের কবি তিনি, অথচ তথাকথিত বেহিসাবি কবিস্বভাবের যে ধারণা আমাদের তার সঙ্গে যে তাঁর মন্দ্র সুভদ্র জীবনযাপনকে ঠিক মেলানো চলে না!     

না, আমাকে চিনতেন না শঙ্খ ঘোষ। অনেক মানুষের মধ্যে থাকলে স্বস্তি বোধ করি না, তাই বার দুয়েক মাত্র গেছি হয়তো কবির সেই বিখ্যাত অ্যাপার্টমেন্টে। প্রথমবার, প্রথম বই বেরনোর পর, প্রকাশকের কথামতো অসমসাহসে ভর করে, কবির জন্মদিনেই। তখন স্থায়ী কিছু রোজগার নেই, তবু 'বিবাহ কি আজও আর তেমন ঘটনা' - ভাস্কর চক্রবর্তীর এই পঙক্তিকে শিরোধার্য করে আমরা দু'জন কবিতালিখিয়ে সদ্য বেঁধেছি সংসার। খাবারের প্লেট হাতে মহা বিড়ম্বনায় পড়েছি আমরা দুই তরুণ-তরুণী, পাশে বসে আমাদের দুঃসাহসের খুব প্রশংসা করছেন কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত। নন্দনচত্বরে, লিটল ম্যাগাজিন মেলায় কীভাবে দেখা হয়েছিল আমাদের - সে কথা জেনে শঙ্খবাবু এ ঘটনাকে আখ্যা দিচ্ছেন 'মেলার উপকারিতা' বলে। তারপরে আলাদা করে অন্যদিকে ডেকে নিয়ে স্নেহভরে জিজ্ঞাসা করছেন পরিবারের খুঁটিনাটি, অর্থাৎ এমতাবস্থায় আমরা বস্তুত কেমন আছি, চলছে কেমন করে তার হালহদিশ, গুরুজনেরা যেমনটা করেন। সেইদিন বুঝতে পেরেছিলাম তাঁকে 'অভিভাবক' এর ভূমিকায় কেন এত মানায়!  

এরকম সর্বজন মান্যতা আর কোনো কবি অর্জন করবেন কিনা জানি না। 'শঙ্খ ঘোষ কি কিছু বললেন?' - আমাদের বাংলায় সামাজিক বৌদ্ধিক সঙ্কট মুহূর্তে এই এক তাকিয়ে থাকার জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। তবু, বাংলা ভাষায় অনেক যুগ থেকে যাবে তাঁর কবিতা আর গদ্য, এটুকুই যা ভরসা।

Powered by Froala Editor