অচলপত্রে দীপ্তেন সান্যাল একবার বলেছিলেন, বিখ্যাত কোনো ব্যাক্তির স্মৃতিচারণে সেই ব্যক্তি অপেক্ষা যিনি সেই স্মৃতিচারণ করছেন তাঁর আমিত্ব প্রকট হয়ে ওঠে। দিনের শেষে এও একান্ত ব্যক্তিগত এক স্মৃতিচারণ। তাই গোটা লেখায় ব্যক্তি আমিকে বাদ দেওয়া মুশকিল। চেষ্টা করছি তাঁকে আড়ালে রাখার।
২০১৭ সালের শুরুর দিকে একটা দুষ্প্রাপ্য বই পাওয়া গেল। রিচার্ড ইয়ান্টুর নামে এক জার্মান শিল্পীর অনুবাদে এবং পাতায় পাতায় ছবিতে ভরপুর এই ফোলিও সাইজের বইটি বিশ্বভারতীর লাইব্রেরিতেই ছিল। ততদিন কেউ খেয়াল করেননি। বইটি সবদিক থেকেই অসামান্য। বইটির নাম বাংলায় অনুবাদে হয় ‘চৌদ্দ কবিতা’। আখ্যাপত্রে জার্মান ভাষায় লেখা “এটি বইটির প্রথম সংস্করণ, যা ১৯২০ সালে প্রকাশিত হল। ঠাকুরের যে গান ও কবিতাগুলো এই বইতে স্থান পেয়েছে, তা প্রকাশক কার্ট উলফ, মিউনিখের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত। বইটির ৪০০টি কপি মুদ্রিত হল। ১-১০০ নম্বর কপি সম্পূর্ণ চামড়ায় বাঁধাই হয়ে জার্মান অধ্যুষিত জাপানে প্রেরিত হয়েছে। ১-২৫ নম্বর কপিতে লিথোগ্রাফগুলো শিল্পী নিজের হাতে রং করেছেন। এই বইটির নম্বর ২০৩।”
খুব স্বাভাবিকভাবেই এমন একটা বই পেয়ে সবাই বেশ উত্তেজিত। কিন্তু কী কী কবিতা বাছা হয়েছে? পুরোটাই আছে না অংশিক এসব না জানতে পারলে তো জানা সম্পূর্ণ হয় না। অধুনা অনিয়মিত এক পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী থেকে একদিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। পিএইচডি চলাকালীন জার্মান শিখেছিলাম। ফলে পাঠোদ্ধারে কোনোরকম সাহায্য করতে পারব কিনা এই জন্যে। আমি তো এক কথায় রাজি। মেইল বাহিত হয়ে গোটা বইটির দারুণ এক স্ক্যান কপি পেয়ে গেলাম (মূল বইটি দেখার সৌভাগ্য এখনও হয়নি)। এ কী বই! প্রতি পাতাজোড়া অসামান্য সব ছবি। আচমকা দেখলে মনে হয় পিকাসোর আঁকা। এবং বেশ কিছু ন্যুডস। রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে যা আমরা ভাবতেই পারি না। এমন বৈপ্লবিক বই পেতেই উদ্ধার করতে বসে গেলাম। কিছু পড়াশুনো করে বোঝা গেল কার্ট উলফ তখনকার জার্মানির এক বড়ো প্রকাশক। এ বইয়ের ইতিহাস বড়ো বিচিত্র। রবি ঠাকুর নিজে এই বইয়ের কপি পেয়েছেন অনেক পরে। তাঁর জার্মান যাত্রাকালে। ইয়ান্টুর মূল বাংলা থেকে কবিতা অনুবাদ করেননি। করেছেন কবির ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশিত অনুবাদের ভাবানুবাদ। তাও গদ্যে।
এবার সেই অনুবাদের অনুবাদ এমন চেহারা নিয়েছে যে সেখান থেকে মূল কবিতা খুঁজে পাওয়া শুধু দুষ্করই না প্রায় অসম্ভব। যদি না… যদি না শঙ্খ ঘোষের মতো কোনো রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সাহায্য করেন।
আরও পড়ুন
বঙ্গসমাজের শেষ আলোকবর্তিকা
আমি আমার নিবেদন জানালাম সেই পত্রিকার সম্পাদকদের কাছে। আবেদন মঞ্জুর হল। তাঁরাই আমাকে শঙ্খবাবুর ফোন নম্বর দিলেন। তখনও তিনি মোবাইল ব্যবহার করতেন না। ল্যান্ড লাইনের নম্বর। ফোন করতেই অতি পরিচিত কণ্ঠ “বলুন।” যথারীতি পরিচয় দিয়ে ফোনের কারণ বললাম।
আরও পড়ুন
পাঠকের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া ফুরোবে না কোনোদিন
“এসব আলোচনা তো ফোনে করা যাবে না। আপনি বরং একদিন আমার বাড়ি আসুন। রবিবার না। ওদিন অনেকে থাকেন। অন্য কবে আপনার সুবিধে হবে?”
আরও পড়ুন
বাংলা সাহিত্যজগতে নক্ষত্রপতন, প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ
আমি তো অবাক! শঙ্খ ঘোষ আমার সুবিধে জিজ্ঞেস করছেন! শেষে উনিই বললেন এক বুধবার সন্ধ্যেবেলা ওঁর বাড়ি যাবার জন্য। সে বাড়ি তীর্থের মতো। অনেকেই গেছেন। হয়তো একাধিকবার। আমি সেই একবারই। বইয়ের পাতাগুলোর ফটোকপি করে নিয়ে গেছিলাম। উনি উলটেপালটে দেখে বেশ অবাক হয়েই বললেন “এর কথা তো জানতামই না!” তারপর শুরু হল লাইন অফ অ্যাকশানের আলোচনা। ঠিক কীভাবে কাজটা হবে? আমি আগেই চোখ বুলিয়ে বুঝেছিলাম একে তো অনুবাদের অনুবাদ, তায় আবার সব কবিতার গোটাটা নেই। কোনো কোনো কবিতা মাঝখান থেকে তুলে দেওয়া, কন্টিনিউটি নেই, কোথাও আবার একটা কবিতা শেষের পর বিরতি না দিয়েই অন্য কবিতা শুরু হয়ে যাচ্ছে। ওঁকে বললাম সেই অসুবিধের কথা। অসুবিধে আরও একটা ছিল। আমি চাকরিসূত্রে তখন মেদিনীপুরে পোস্টিং। ফলে নিয়মিত আসা সম্ভব হবে না। উনিই আমাকে সহজ করে দিলেন। ততক্ষণে অহর্নিশের সদস্য হিসেবে আমার পরিচয় পেয়ে আপনি নেমে গেছে তুমিতে। বললেন, “তোমায় আসতে হবে না। তুমি আগে জার্মান কবিতাগুলোর আক্ষরিক অনুবাদ করে ফেল। তোমার যদি কিছু মনে হয় সেটাও লেখ। তারপর আমায় ফোন কর। ফোনেই আলোচনা করে নেওয়া যাবে।”
শুরু হল আমার আর শঙ্খ ঘোষের যৌথ প্রজেক্ট। তখনই দেখেছিলাম একটা মানুষ নিজের কাজে কতটা ডেডিকেটেড হতে পারেন। আমি সব কবিতা আক্ষরিক অনুবাদ করে ওঁকে স্পিড পোস্টে পাঠালাম। উনি পেয়েই প্রাপ্তি স্বীকার করলেন। প্রতি অনুবাদের পাশে আমি আমার ধারণায় মূল কবিতা কোনটা হতে পারে সেটা লিখেছিলাম। তিনটে বাদে। সেই তিনটে উদ্ধার আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
রাতে এল ফোন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন আমি ব্যাস্ত কিনা। তারপরেই শুরু হল দীর্ঘ ফোনালাপ। অনুবাদ ধরে ধরে। শব্দ ধরে ধরে। আমার ধারণাওগুলো প্রায় প্রত্যেকটাই মেনে নিলেন একটা বাদে। সেটা পরে বলছি। কিন্তু কেন সেটা হবে, কী সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন, ভাবা যায় না। প্রথমদিন ফোনে মাত্র চারটে কবিতা নিয়ে আলোচনা হল। রাত বাড়ছে। ঠিক হল পরের দিন একই সময় ফোন করবেন তিনি। শুরু হয়ে গেল আমার শঙ্খ ঘোষের ক্লাস। প্রতিদিন ফোন আসে। উনি বলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি। মাঝেমাঝে বলে ওঠেন “তোমার এই নিয়ে কী ধারণা সেটাও বল। অন্যমত থাকতেই পারে!” আমি কী বলব! রবীন্দ্রনাথ নিয়ে, তাও শঙ্খ ঘোষের সামনে! মুশকিল হল একটা কবিতায় গিয়ে। আক্ষরিক অনুবাদের ফলে আমার নিশ্চিত মনে হচ্ছিল কবিতাটা ‘শুভক্ষণ’ ছাড়া কিছু হতেই পারে না।
‘ওগো মা,
রাজার দুলাল যাবে আজি মোর
ঘরের সমুখপথে,
আজি এ প্রভাতে গৃহকাজ লয়ে
রহিব বলো কী মতে।’
শঙ্খবাবু ওটা আসতেই আমায় বললেন “দেখো তুমি শুভক্ষণ বলছ বটে, কিন্তু আমার এটা পড়ে অন্য একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। খেয়া কাব্যগ্রন্থের “ত্যাগ” বলেই তাঁর সুন্দর কণ্ঠে আবৃত্তি করে উঠলেন-
‘ওগো মা,
রাজার দুলাল গেল চলি মোর
ঘরের সমুখপথে,
প্রভাতের আলো ঝলিল তাহার
স্বর্ণশিখর রথে।
ঘোমটা খসায়ে বাতায়নে থেকে
নিমেষের লাগি নিয়েছি মা দেখে,
ছিঁড়ি মণিহার ফেলেছি তাহার
পথের ধুলার 'পরে।’
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনে চলেছি কেবল। মুগ্ধতা কাটার আগেই প্রশ্ন, “আমি বলছি বলে না। তোমার নিজের অধ্যয়ন কি বলে?” বলে আবার সেই শব্দ ধরে ধরে বুঝালেন কেন ত্যাগই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। শুভক্ষণ না। কিন্তু সেই বলায় কোনো অহংকার নেই। চাপিয়ে দেওয়া নেই। যেন দুই সহকর্মী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। যে তিনটে কবিতার হদিস পাইনি সেগুলো বলে দিলেন। কারণ সহ। চারদিনের প্রায় পাঁচ ঘণ্টার ফোনালাপে আমার শঙ্খ ঘোষের কবিতার ক্লাস শেষ হল।
এবং হল না। লেখাটা তৈরি করলাম। ওঁকে ফোনে গোটাটা শোনালাম। উনি ধৈর্য ধরে শুনলেন। সম্মতি দিলেন। আমি লেখা পাঠিয়ে দিলাম। এরপর হপ্তাদুয়েক কেটে গেছে। আচমকা আবার ওঁর ফোন। “তুমি কি লেখাটা পাঠিয়ে দিয়েছ”। জানালাম, হ্যাঁ। বললেন, “তুমি ওঁদের বল একটু অপেক্ষা করে যেতে। কবিতাগুলো দিলেই তো শুধু হবে না, কোন কবিতা কোন কাব্যগ্রন্থে প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল, তাঁর প্রকাশকাল, সেটাও তো জরুরি।” বটেই তো। এভাবে তো ভাবিনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বললেন “আমি একটা তালিকা বানিয়েছি। হাতের সামনে কাগজ পেন আছে?” রাতে ডিনারে বসেছিলাম। “হ্যাঁ হ্যাঁ আছে” বলে কোনোক্রমে কাগজ পেন নিয়ে বসলাম। শঙ্খবাবু কবিতা ধরে ধরে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ও কবিতার প্রকাশকাল বলে গেলেন। আমার মতো এক অর্বাচীনের কথা তিনি মনে রেখেছেন। শুধু রাখেননি। কীভাবে সেই কাজ আরও নিখুঁত, আরও সুন্দর আরও নির্ভুল করা যায় তাঁর দায়িত্ব নিয়েছেন নিজের কাঁধে।
সেই লেখা পত্রিকা অফিসে জমা পড়ার পর এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এরপর কয়েকবার ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। সেই লেখার কথা জানতে চেয়েছেন। সত্যিটাই জানিয়েছি। জানি না সে লেখা কবে প্রকাশ পাবে। আদৌ পাবে কিনা। কিন্তু আমার কোনো ক্ষোভ নেই। বরং তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁদের জন্যেই শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে আমার একটা বড়ো গর্বের জায়গা চিরকাল বুকের মধ্যে পুষে রাখতে পারব। অন্তত এক সপ্তাহের জন্য হলেও শঙ্খ ঘোষের কাছে রবীন্দ্রনাথ পাঠের সুযোগ আমার হয়েছে।
শঙ্খ ঘোষ। আমার মাস্টারমশাই।
Powered by Froala Editor