পাঠকের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া ফুরোবে না কোনোদিন

তাঁর মৃত্যুসংবাদে মুহ্যমান বাঙালি। অভিভাবক হারানোর বিষণ্ণতা গ্রাস করেছে গোটা জাতিকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শোকজ্ঞাপনের ঢল। হয়তো এই শোকজ্ঞাপনের উদযাপন থেকে দূরে অনেকেই। নীরবে জারিয়ে নিচ্ছেন মহাপ্রয়াণের ব্যথা। এরই মধ্যে, ফেসবুকের একটি পোস্ট। বলা ভালো, কমেন্ট। কোনো খবরের নিচে, মন্তব্য করেছেন এক ‘বঙ্গসন্তান’। বক্তব্য খানিকটা এইরকম – শঙ্খ ঘোষ হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন। মুসলমানদের তোষণ করতেন। ফলে, তাঁর শেষকৃত্য যেন হিন্দুমতে না হয়। তাঁকে মুসলিম আচার মেনে কবর দেওয়া হোক।

দেখামাত্র চমক। এত রাগ, এত দ্বেষ! মৃত্যুতেও রেহাই নেই আক্রমণে! অবশ্য, কবেই বা আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছেন তিনি! যখনই অন্যায় দেখেছেন, গর্জে উঠেছে কলম। প্রয়োজনে নেমেছেন পথে। এই তো, বছর দুয়েক আগেই, লিখেছিলেন ‘রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন।’ তাতে রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের এক নেতা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন অবজ্ঞা। না, বিচলিত হননি শঙ্খ ঘোষ। আবার, এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনে যখন লেখেন ‘এ-মাটি আমারও মাটি সেকথা সবার সামনে কীভাবে প্রমাণ করব আজ’, ক্রুদ্ধ হয় কেন্দ্রের শাসকও। অতএব, এত ক্ষমতাসীনদের এত রাগ নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন তিনি, সামান্য ফেসবুক-কমেন্টে কীই বা আসে-যায় তাঁর!

১৯৯৩ সালে বেরিয়েছিল তাঁর ‘লাইনেই ছিলাম বাবা’ কাব্যগ্রন্থটি। সেই কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতার শেষ লাইন – ‘রাতে ঘুমোবার আগে ভালোবাসবার আগে প্রশ্ন করো কোন দল তুমি কোন দল’। এই বইয়েই ছিল ‘পুলিশ কখনো কোনো অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ’-এর মতো পঙক্তি। জানি না, সে-সময় কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল এইসব কবিতা নিয়ে। কিন্তু তাতে যে তাঁর কিছুই যায় আসেনি, বলাই বাহুল্য।

না, কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না তিনি। বলা হত, বাঙালির ‘বিবেক’ তিনি। যেখানে যা অন্যায়, অবিচার – তার বিরুদ্ধেই গর্জে উঠত কলম। স্বল্পবাক – ভালোবাসতেন চুপ থাকতেই। কিন্তু নৈঃশব্দ্যের ভেতর থেকে ঢেউ তোলার কাজে ছেদ পড়েনি কোনোদিনই। আমরা সাধারণ ছাপোষা মানুষ। দিন-আনি-দিন-খাই জীবনে যে-প্রতিবাদ আমরা করতে পারি না, অথচ ভেতরে ভেতরে গর্জাই – তাকে কবিতার রূপ দেওয়ার এমন বিশ্বকর্মা আর কেই বা ছিলেন!

সেখানেই জেগে উঠছে শূন্যতা। বর্তমানের এই যে ভয়ংকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি – বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নিরন্তর আক্রমণ – অগ্রণী সৈনিক চলে গেলে, লড়াই টাল খাবে বইকি! তিনি ছিলেন, অসুস্থ হলেও, ছিলেন তিনি – বাংলার সংস্কৃতিকর্মীদের কাছে এই সাহস অপরিমেয়। দীর্ঘ সাত দশক ধরে যাঁর কলম সাহস জুগিয়েছে এই জাতিকে – তার স্তব্ধতা আরও শূন্যের মধ্যেই ঠেলে দিল আমাদের।

তিনিই ‘দুর্যোধন’ কবিতায় লিখেছিলেন – ‘আমিই গম্বুজ চূড়া আমি দেশ আমিই সমাজ।’ ক্ষমতালোভীর সেই আস্ফালন যখন কবিতায় ফুটে ওঠে, আন্দাজ করা যায় রক্তাক্ত অন্তিমও। কবিতার মধ্যে দিয়েই শাসক বা ক্ষমতাসীনের প্রতি বারবার ব্যঙ্গ ছুঁড়ে দিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ। পোয়েটিক পার্সোনা-য় সেই রিপুরাজ-কে বসিয়ে, বলিয়ে নিয়েছেন একের পর এক উদ্ধত উচ্চারণ – যা পতনের কারণ হয়ে ঘুরে আসবে তার দিকেই। ব্যুমেরাং-এর এমন সার্থক ব্যবহার, এমন স্যাটায়ারধর্মী মনোবিশ্লেষণ ও তার মধ্যে দিয়ে অন্যায়ের প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদ – শঙ্খ ঘোষ ছাড়া আর কেউ এইভাবে পেরেছেন কি বাংলা কবিতায়?

অথচ এই মৌনী রুদ্রই আবার অসামান্য প্রেমিক। তবে তাঁর প্রেম উচ্চকিত নয়। মৃদু। যে কবির প্রতিবাদী সত্তা এত বন্দিত, তাঁর প্রেমিক সত্তাকে নিয়ে আলোচনায় যেন বড়োই অনীহা আমাদের। যেমন আমিও, আভাসমাত্র দিয়েই তাৎক্ষণিক এই লেখায় এড়িয়ে গেলাম প্রেম-প্রসঙ্গ। শুধু মনে ভাসছে, কাউকে আড়ালে ভীষণ বকতে চেয়েছিলেন কবি। উপলব্ধির চূড়ায় বসে লিখেছিলেন, সারাজীবন বইতে পারা সহজ নয়। যেমন সহজ নয় হাতের ওপর হাত রাখাও। 

সমস্ত প্রেম, প্রতিবাদ, উপলব্ধি আজ থেকে পাঠকের স্মৃতিতে। ‘স্মৃতি’ শব্দটার আঘাতদায়ী ক্ষমতা লক্ষ করেছি এর আগেও। বর্তমান-কে অতীত করে দিতে বিন্দুমাত্র হাত কাঁপে না তার। আর যদি কেউ অতীত না হন? নতুন থেকে নতুনতর পাঠে জীবন্ত হয়ে ওঠেন যদি? তাঁকে প্রণাম জানাই আমরা। সাহস পাই, না-থেকেও থাকার এই অসম লড়াইয়ে জয়মাল্য ধারণ করলেন বলে।

শঙ্খ ঘোষের ক্ষেত্রে সেই মালার ফুলগুলি হল তাঁর কবিতা। আর পাঠক হলেন সেই দোকানি, জল ছিটিয়ে-ছিটিয়ে ফুলগুলিকে তাজা রাখতে পারেন দিনের পর দিন। অনন্তকাল। এই বোঝাপড়া কোনোদিন ফুরোলে, বুঝব, সত্যিই ঝরে যাওয়ার সময় এসেছে বাঙালির...

Powered by Froala Editor