আলোচনায় ‘উপেক্ষিত’, ভাঙা মেরুদণ্ড নিয়ে ধুঁকছে শঙ্করপুরও

“আমরা দোতলায় রয়েছি বর্তমানে। নিচের তলায় সম্পূর্ণ জল ঢুকে গেছে। যাঁদের একতলা বাড়ি, তাঁরা অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে। পাশের গ্রামে একাধিক বাড়ি ধুইয়ে নিয়ে গেছে জলস্রোত।”

বলছিলেন শঙ্করপুরের বাসিন্দা রঞ্জু সেনাপতি। ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ বয়ে গেছে গতকাল দুপুরেই। কিন্তু এখনও বিপদের মধ্যেই প্রহর গুনছে শঙ্করপুর। বিপর্যস্ত শঙ্করপুরের ছবি রীতিমতো চমকে ওঠার মতোই। গতকাল ঝড় আছড়ে পড়ার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা। বাঁধ উপচে জল ঢোকা শুরু হয়েছিল সকাল থেকেই। যত বেলা গড়ায় ততই ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতম রূপ নেয় সমুদ্র।

ভয়ঙ্কর জলের তোড় সমুদ্রের বোল্ডার ছিটকে এনেছে তো বটেই, ভেঙেছে উপকূলবর্তী একাধিক সরকারি কার্যালয়। খড়-কুটোর মতোই ভেসে গেছে ছোটোখাটো দোকান। তাসের ঘরের মতোই কোথাও কোথাও ধ্বসে পড়েছে বাঁধ। শঙ্করপুর সমুদ্র উপকূল লাগোয়া খাড়িতে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে ট্রলার। চলে সারাইয়ের কাজ। সেখানেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ছাপ। জলস্রোতে বাঁধের সঙ্গে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক ট্রলার। 

বিকালে অবশ্য জলস্তর নামে খানিকটা। তবে রাতে ভরাকোটালে আবার বিপদের হাতছানি। সেইসঙ্গে  ভারী বৃষ্টিপাত আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে। দীর্ঘক্ষণ জল জমে থাকার কারণে আরও বহু বাড়ি ধ্বসে পড়তে পারে। আর উদ্ধারকার্য? রঞ্জুবাবু জানালেন, “এখনও পর্যন্ত সেভাবে কোনোরকম পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। জমে থাকা জল পাম্প দিয়ে বের করারও সুযোগ নেই। সমস্ত খালই উপচে উঠেছে সমুদ্রের জলে।” যেসব অঞ্চল একেবারে ভেসে গেছে, শুধু তাঁদের কাছেই আপদকালীন ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন এনডিআরএফ ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।

একদিকে যখন বাসস্থান সংকটে শঙ্করপুরের হাজার হাজার বাসিন্দা, তখন আরেকদিকে উপদ্রব বেড়েছে সাপের। গর্তে জল ঢুকে যাওয়ায় মানুষের বাড়িতেই ঢুকে পড়ছে বিষধর সাপ। এই অবস্থায় বাড়িতে থাকাও যেন নিরাপদ নয়। 

প্রকৃতির সঙ্গে এই সংঘাত আরও বড়ো আঘাত এনেছে জীবিকায়। এমনিতেই লকডাউন এবং মহামারীর কারণে ধুঁকছিল পর্যটননির্ভর শঙ্করপুর। তার ওপরে ইয়াসের হানা কবরে পুঁতে দিয়েহে শেষ পেরেকটাও। উপার্জন তো দূরের কথা, ছোটো ব্যবসায়ীদের আবার নতুন করে পরিকাঠামো পুনরুদ্ধার করতেই হিমশিম খেতে হবে বছর খানেক। যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মৎস্যজীবীদের ট্রলার, তেমনই চাষের জমিতে জমে রয়েছে লবণাক্ত জল। মাটিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে আগামী দু’-তিন বছর এই জমি চাষযোগ্য থাকবে না বলেই আশঙ্কা গ্রামবাসীদের। 

আক্ষরিক অর্থেই গোটা শঙ্করপুর যেন ধ্বংসস্তূপ। ইয়াস মোকাবিলায় দীঘা এবং মন্দারমণি প্রধান্য পেলেও এখনও পর্যন্ত খানিকটা অন্ধকারেই মধ্যবর্তী এই অঞ্চল। উপেক্ষিতও বটে। চলমান দুর্যোগের সামনে দাঁড়িয়ে এমনই এক অসম লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন শঙ্করপুরের এলাকাবাসী…

Powered by Froala Editor