জনৈক সমকামীকে বিয়ে করেছিলেন ‘হিউম্যান কম্পিউটার’ শকুন্তলা দেবী, পরবর্তীকালে সমকামিতা নিয়ে লিখেছেন বইও

সালটা ১৯৭৭। সাউথার্ন মেথডিস্ট ইউনিভার্সিটিতে দাঁড়িয়ে আশ্চর্য প্রতিভার নজির রাখছেন শকুন্তলা দেবী। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে তিনি বলে দিচ্ছেন একটি ২০১ অঙ্কের সংখ্যার ২৩তম মূল। সেই উত্তরের যথার্থতা বিচারের জন্য সবাইকেই কম্পিউটারের সাহায্য নিতে হল। আর তাতে দেখা গেল কোথাও বিন্দুমাত্র কোনো ভুল করেননি শকুন্তলা দেবী। কিন্তু পাশাপাশি সেই বছরেই যে আরও এক নজিরবিহীন কাজ করে বসছেন শকুন্তলা দেবী, তার খবর হয়তো আমরা সেভাবে রাখি না।

১৯৭৭ সালেই বিকাশ পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত হচ্ছে শকুন্তলা দেবীর লেখা বই, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অফ হোমোসেক্সুয়ালস’। ভারতের মাটিতে রামধনু আন্দোলনের আঁচ পড়তে তখনও কয়েক দশক বাকি। প্রাইড প্যারেডের জৌলুস কোনো শহরকেই মুগ্ধ করেনি। সমকামিতা তখনও এদেশে নিছক মূল্যবোধের অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ সেই সময়ে দাঁড়িয়েও সমকামিতার পক্ষে সওয়াল করে গিয়েছেন শকুন্তলা দেবী। এমনকি যে সমাজ মানুষকে নিজের মতো করে বাঁচার স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়, সেই সমাজের মূল্যবোধ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন ‘হিউম্যান কম্পিউটার’ শকুন্তলা দেবী। আর সম্ভবত এদেশে সমকামের পক্ষে সেটাই প্রথম প্রকাশিত বই।

শকুন্তলা দেবীর বইটি অবশ্য সরকার বাজেয়াপ্ত করেনি। কিন্তু তাঁর লেখা বিভিন্ন অঙ্কের বইয়ের পাশে এক আসনে জায়গা পায়নি এই বইটি। এমনকি লেখিকার পক্ষে বা বিপক্ষেও ওঠেনি কোনো প্রশ্ন। যেন অদ্ভুতভাবে এই একটি লেখার প্রতি উদাসীন থেকেছেন সকলে। কিন্তু শকুন্তলা দেবীকে চিনতে গেলে এই বইটিকে যে বুঝতেই হবে। তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই সন্দর্ভ। ১৯৬০ সালে কলকাতার আই.এ.এস অফিসার পরিতোষ ব্যানার্জির সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন শকুন্তলা দেবী। কিন্তু বিবাহের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি জানতে পারেন পরিতোষ বিষমকামী যৌনতার মানুষ নন। তিনি পুরুষদের প্রতিই আকর্ষণ বোধ করেন। বলা বাহুল্য এমন একটা দাম্পত্য সুখের হয়নি। তবু তার মধ্যেই এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে। এবং নিজের ভাগ্যকে দোষ না দিয়ে শকুন্তলা দেবী বুঝতে পেরেছেন তাঁর এই পরিণতির জন্য দায়ী সেই সমাজ, যার জন্য পরিতোষ নিজের পরিচয় প্রকাশ্যে আনতে পারেননি। সমাজের চাপেই তিনি বাধ্য হয়েছেন শকুন্তলা দেবীকে বিবাহ করতে।

এখন অবশ্য অনেকে প্রশ্ন তোলেন, সমকামী জীবনের কথা বলার অধিকার আদৌ কোনো বিষমকামী মানুষের আছে কিনা। এই একটা দেওয়াল তোলার সম্ভবনাও যেন বুঝতে পেরেছিলেন শকুন্তলা দেবী। তাই নিজের লেখাতেই উত্তর দিয়ে গিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, মানুষ হয়ে মানুষের যন্ত্রণার কথা বলছেন তিনি। আর এভাবে সমাজের প্রত্যেক মানুষ যদি একে অপরের যন্ত্রণার শরিক হতে পারেন, তাহলেই সমাজ বদলাবে। কিন্ত জীবনের এই অন্য রঙের রেখাচিত্রই যেন হারিয়ে গেল কোথায়। এমনকি আজ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে শকুন্তলা দেবীকে নিয়ে যে পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা মুক্তি পেল, তাতেও কি আছে সেই অনুভূতির বার্তা? অনেক সমালোচকই দাবি করছেন, শকুন্তলা দেবী যেমন সহানুভূতির সঙ্গে সমকামী জীবনকে বুঝতে পেরেছিলেন, তার সামান্যটুকুও নেই সিনেমার মধ্যে। বরং যেভাবে দেখানো হয়েছে তাঁর জীবনকে, তাতে যেন সমকামী মানুষের প্রতি বিদ্বেষই প্রকাশ পায়। আজ ২ বছর হয়ে গেল, এদেশে সমকামী সম্পর্ককে অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। পূর্ণ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলেও তার জন্য লড়াই চলছে সমাজের প্রতিটি আবর্তে। কিন্তু এর মধ্যেও কি আমরা তাঁদের জীবনকে সেই রঙিন রেখায় ভাবতে পারছি, ৪৩ বছর আগে শকুন্তলা দেবী যেভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলেন?

আরও পড়ুন
"অপেক্ষায় আছি কোর্টের রায়ের", প্রহরকে জানালেন কেরালার সমকামী দম্পতি

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সাতরঙা কার্পেট নিয়ে, কলকাতায় হাজির আফগানি সমকামী লেখক

More From Author See More