বিহারের চাইবাসায়, রোরো নদীর ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দুই তরুণ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সঙ্গে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। উদ্দেশ্য, তাঁদেরই এক বন্ধুকে খোঁজা। বন্ধুকে হাওড়া স্টেশনে ছাড়তে যাবে বলে সেই যে নিখোঁজ হল সে, আর পাত্তা নেই। প্রায় গোটা কলকাতাই চষে ফেলা হল। কিন্তু তাঁকে আর পাওয়া গেল না। এমন সময় খবর এল, বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর কাছে, চাইবাসায় রয়েছেন তিনি। সুনীল আর সন্দীপন ঠিক করলেন, সেখানেই যাবেন। গিয়ে দেখলেন আরেক কাণ্ড— সমীর যে ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেছে অন্যত্র! তাহলে বন্ধুটি? রোরো নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে সেই কথাই ভাবছিলেন দুজনে।
যত এগোচ্ছেন, ততই যেন চারপাশের প্রকৃতির প্রেমে পড়ছেন। এমন সুন্দর নদী! যে ডাকবাংলোতে থাকছেন, সেটিও বড়ো মনোরম। বন্ধুটির কথা কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গিয়েছিলেন সুনীল-সন্দীপন। খোলা রাস্তায় ভর করে এলেন রবীন্দ্রনাথ। দুজনেই দরাজ গলায় শুরু করলেন গান। হঠাৎ কাছেই একটি বাড়ি থেকে চিৎকার ভেসে এল। পরিষ্কার বাংলা ভাষায় কে যেন বলে উঠল, “এখানে আমি ছাড়া আর কে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়?” সুনীল এবং সন্দীপন, দুজনেই হতভম্ব। আরও অবাক হলেন, যখন দেখলেন ওই বাড়ি থেকেই বেরিয়ে এল একমুখ দাড়ি, পাঞ্জাবী ও চশমা পরিহিত এক তরুণ— শক্তি চট্টোপাধ্যায়। যাক! শেষে রবীন্দ্রনাথই সন্ধান দিলেন শক্তির…
বাংলা সাহিত্যের আকাশে তিনি ছিলেন এক পাগলা ঘোড়া। এমন একজন, যাকে কোনভাবে খাঁচায় আটকে রাখা যেত না। বেঁধে রাখলে, বারবার দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যাবেন অন্য কোথাও। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জীবন ছিল এমনই। উপন্যাস লিখতে লিখতে কখন যে কবিতার স্রোতে ভেসে গিয়েছিলেন, বুঝতে পারেননি। ভাগ্যিস এসেছিলেন! নাহলে কবিতার জগতটা ‘শাক্ত’ হত না…
শক্তির জীবনও ছিল একটি মিথের মতো। তাঁকে নিয়ে কত গল্পকথা, কাহিনির বেষ্টনী। একটি তথ্যচিত্রে নিজেই বলেছিলেন তাঁর বিখ্যাত একটি কবিতা সৃষ্টির পেছনের গল্পটি। একবার মেদিনীপুরের হিজলিতে গেছেন শক্তি। শিক্ষকতার সূত্রে সেখানে তাঁর দুই বন্ধু থাকতেন। তাঁদের সঙ্গে আড্ডায়, গল্পে মেতে উঠেছেন তিনি। সেখানেই স্বভাববশত দু’বোতল মহুয়া খেয়ে ফেললেন শক্তি। নেশায় আচ্ছন্ন শরীর; কিন্তু মন ততক্ষণে অন্য জগতে চলে গেছে। বেশিক্ষণ লাগল না, একটি লাইন চলে এল মাথায়। কাছেই ছিল কিছু কাগজ। একটানে সেগুলো নিয়ে লিখে ফেললেন আস্ত একটি কবিতা— ‘অবনী বাড়ি আছো?’ তারপর এক হাতে মহুয়া, অন্য হাতে পাণ্ডুলিপি নিয়ে সদ্যরচিত কবিতা পড়তে শুরু করেন। কেউ কেউ বলেন, কবিতাটি বন্ধু অবনী নাগকে নিয়ে লিখেছিলেন তিনি। সত্যি কিনা, জানা যায়নি।
কিংবা ধরা যাক প্রথম কবিতার বই বেরনোর গল্প। ১৯৫৮ সাল। ঔপন্যাসিক শক্তির মনে ততদিনে ভর করেছে কবিতা। এই সময়ই পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের কাছে হাজির হলেন তিনি। তারপর সেই যে উধাও হলেন, আর পাত্তা নেই। প্রকাশক একদিক দিয়ে আসেন, তাঁকে দেখে ‘ফুটপাত বদল করে’ চলে যান অন্য রাস্তায়। এ তো মহা ঝামেলা। পরে জানা গেল, কবি নিজে গিয়ে প্রেসে প্রুফ দেখে দিয়ে এসেছেন; বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘নিকষিত হেম’। প্রচ্ছদও তৈরি কয়ে গেল। গল্প এখানেই শেষ হতে পারত, হল না। প্রেসের মালিক বিরক্ত হয়ে গেলেন। পাণ্ডুলিপির কবিতা ফেলে দিয়ে নিত্যনতুন কবিতা যোগ করছেন শক্তি। সঙ্গে বদলে যাচ্ছে বইয়ের নামও। আর তখন ছিল লেটার প্রেসের যুগ। বারবার কম্পোজ করে বদলাতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছেন প্রেস মালিক। কিন্তু উল্টোদিকের মানুষটির নামও যে শক্তি চট্টোপাধ্যায়! তিনি সবাইকে ‘ম্যানেজ’ করিয়ে ছাড়লেন। শেষ পর্যন্ত পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার তিন বছর পর, ১৯৬১ সালে শক্তির প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরোয়; নাম ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’…
একটা সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হত। এখনও ‘সুনীল-শক্তি’ একটি রূপকথার আখ্যান হয়ে আছে। জীবনের ওই দামালপনা, প্রতিটা মুহূর্তের গভীরে গিয়ে রসাস্বাদন করা— এমনই ছিল তাঁদের যাপন। তখন সুনীল নিতান্তই তরুণ। সদ্য সাহিত্য জগতে পা রেখেছেন। পথ চলা শুরু হয়েছে ‘কৃত্তিবাস’-এরও। কফি হাউসে টেবিল দখল করে চলত আড্ডা, তর্ক ও কবিতাপাঠ। পাশের টেবিলের একটি ছেলের দিকে বারবার চোখ যায় সুনীলের। ‘মুখে দাড়ি-গোঁফ, মাথায় পাতলা চুল, সে সর্বক্ষণ বিড়ি খায়।’ বিড়ি নিয়ে ছেলেটির অদ্ভুত টান; ওটা নাকি ‘অভিমানী প্রেমিকার মতন’। একটু খোঁজ নিতে জানা গেল, ‘স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার’ নামে ছেলেটি গদ্য লেখে। আসল নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। পরবর্তী গল্পগুলো এক একটি মিথ। সেখান থেকেই জন্ম ‘সুনীল-শক্তি’র…
আরও পড়ুন
কবিতা কি বাবার লিখে দেওয়া নাকি মায়ের নকল - 'বুনো' নবনীতা ও উত্তরাধিকারের গল্প
শক্তির জীবনে কবিতা, গদ্য বাদ দিয়েও আরও একজনের উপস্থিতি ছিল মারাত্মকভাবে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোটবেলায় সেভাবে তাঁকে না পড়লেও, পরে শক্তি যত পরিণত হয়েছেন ততই ডুব দিয়েছেন রবি ঠাকুরে। উদাত্ত কণ্ঠে কবিগুরুর গান গাওয়া তো তাঁর অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের গানই শক্তিকে সঙ্গীত রচনায় উদ্বুদ্ধ করে। গীতিকার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথা সেভাবে হয়তো সামনে আসেনি আমাদের। একটা সময় প্রায় ৩৬টির মতো গান রচনা করেছিলেন তিনি। শিরোনামও রেখেছিলেন ‘গান’। প্রেম, বিরহ যেমন সেই গানগুলিকে ছুঁয়েছে, তেমনই অজান্তে সেখানে হাজির হয়েছেন রবীন্দ্রনাথও। কিন্তু সেই লেখায় কখনও সুর বসেছিল কিনা, জানা যায় না। তবে শক্তির বেশ কিছু কবিতা পরবর্তীতে গান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ‘একটি পরমাদ’, ‘অবনী বাড়ি আছো’-র মতো কবিতাতেও সুর বসিয়েছেন অনেকে। অবশ্য এমন গণ্ডিতে কবেই বা আটকে থেকেছেন শক্তি! সুযোগ পেলেই পালিয়ে যেতেন অন্য দেশে। এখনও ছুটে বেড়াচ্ছেন হয়তো, নতুন কোনো চরে…
Powered by Froala Editor