কর্মসূত্রে ভারতে এসেছিলেন শেক্সপিয়র। এদেশে বিবাহ করেছেন তিনি। এখানেই আছে তাঁর সমাধিও। কথাগুলো শুনে অবাক হচ্ছেন নিশ্চই। কারণ শেক্সপিয়র মানেই তো আমাদের মনের মধ্যে আসে মধ্যযুগের ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত নাট্যকারের মুখ। আর তাঁর কোনো না কোনো কিংবদন্তি সংলাপ। সে না হয় গেল উইলিয়ম শেক্সপিয়রের কথা। তাঁর সঙ্গে ভারতের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু ‘শেক্সপিয়র’ তো আসলে একটি পরিবারের পদবি। আর ভারতে ঔপনিবেশিকতার গোড়া থেকেই ইংল্যান্ডের অন্য অনেক পরিবারের মতোই ভারতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল শেক্সপিয়র পরিবারও।
ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু জেনে নেওয়া যাক পরিবারের বংশতালিকা। উইলিয়ম শেক্সপিয়রের কাকা ম্যাথিউ, তাঁর ছেলে টমাস। আর এই টমাস শেক্সপিয়রের পৌত্রের পৌত্র জন শেক্সপিয়র। এই জনকে দিয়েই শুরু ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ।
জন শেক্সপিয়র এদেশে এসেছিলেন ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের একজন সাধারণ অফিসার তিনি। কিন্তু পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেই তাঁর সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল খোদ বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে। আর হয়তো সেই কারণেই ভারতের সঙ্গে শেক্সপিয়র পরিবারের যোগাযোগের রেশ থেকে গিয়েছিল বহুদিন পর্যন্ত। ব্রিটিশ আমলের সরকারি নথি ঘেঁটে জন শেক্সপিয়রের অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনার কথাই জানা যায়। তার মধ্যে একটি আবার ভূতের ঘটনা। তাঁর বাবার মৃত্যুর আগে জন কলকাতাতেই ছিলেন। কাজ করতে করতে হঠাৎ নাকি তিনি জানলায় বাবার মুখ দেখতে পেলেন। অফিসের বাকিরাও সেই মুখ দেখেছিলেন। আর সেই অলৌকিক মানুষটির মাথায় নাকি ছিল আরেক বিসদৃশ লম্বা টুপি। পরে নাকি এই টুপি এদেশের ব্রিটিশ কর্মচারীদের ফ্যাশনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই টুপির নামই ছিল চিমনি পট হ্যাট।
ভারতে আসা ব্রিটিশ কর্মচারীদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজনই উন্নতি করতে পেরেছিলেন। আর তার কারণ ছিল তাঁদের অশেষ উদ্যম। এরকমই তিনজন হলেন সিভিল সার্ভেন্ট জন শেক্সপিয়র, মাদ্রাজ বাহিনীর জেনারেল রবার্ট লো এবং উইলিয়ম ম্যাকপিস থাকড়ে। নিজেদের চরিত্রের সামঞ্জস্যই বোধহয় তাঁদের কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। পরবর্তীকালে তৈরি হল বৈবাহিক সম্পর্কও। আর এর পর শেক্সপিয়র পরিবার গড়ে উঠেছে এই তিন ব্যক্তির প্রজন্ম ধরেই।
জন শেক্সপিয়রের ছেলে ট্যালবটের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল উইলিয়ম ম্যাকপিসের মেয়ে এমিলি থাকড়ের। তাঁদের মেয়ে অগস্টার সঙ্গে বিবাহ হয় রবার্ট লোর নাতির। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এমিলির মৃত্যু হয়। পার্ক স্ট্রিট সেমেট্রিতে গেলে এখনও তাঁর সমাধি দেখা যায়। এই পরিবারেই পরবর্তী সদস্য হয়ে আসেন স্যার রিচমন্ড ক্যাম্পবেল শেক্সপিয়র। এদেশে ব্রিটিশ কূটনীতির ইতিহাসে এক অসামান্য মোড় বদলের কাণ্ডারি ছিলে তিনিই। আসলে পলাশির যুদ্ধের পর থেকেই একের পর এক রাজ্য দখল করার দিকেই মনঃযোগ দিয়েছিল কোম্পানি। কিন্তু এতে সামরিক ব্যয় বাড়ছে। আবার অনেক সময় দেশীয় রাজাদের কাছে ব্যাপকভাবে পর্যুদস্ত হয় ব্রিটিশ বাহিনী। এর মধ্যে ব্রিটিশদের সামনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভোপাল রাজ্য। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার ভার দেওয়া হয় ক্যাম্পবেলের উপর। আর ১৮৫০ সালে এই দায়িত্ব নিয়ে তিনি যুদ্ধের সমস্ত সম্ভবনাই বাতিল করে দিলেন। ভোপালের সম্রাজ্ঞী শিকন্দর বেগমকে বললেন, ব্রিটিশরা তাঁর রাজত্ব আক্রমণ করবে না। তিনি নিজের মতো করেই রাজ্য শাসন করবেন। শুধু ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্যের পরিচয় রাখতে হবে তাঁকে। নাহলে আবার যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
এভাবেই ভোপাল সমস্যার সমাধান করেছিলেন ক্যাম্পবেল শেক্সপিয়র। ভোপালের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্ক এমন হয়ে উঠেছিল যে মহাবিদ্রোহের সময় ইংরেজ শক্তিকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন ভোপালের রাণী। এই বিরাট সাফল্যের সম্মান নিয়ে ১৮৬১ সালে ইন্দোরে মারা যান তিনি। তবে ভারতের সঙ্গে শেক্সপিয়র পরিবারের যোগাযোগ শুধু প্রশাসনিক বা সামরিক নয়। বরং ক্যাম্পবেলের পুত্র জন শেক্সপিয়র এই সমস্তকিছু থেকে বেরিয়ে গিয়েও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেননি। বরং এদেশের সাংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছেন তিনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে চিনেছেন এদেশের মানুষকে। এই স্বভাবটা হয়তো পেয়েছিলেন ঠাকুমা এমিলির কাছ থেকে। এমিলি শেক্সপিয়রও তো এদেশের মানুষকে চিনতে চেয়েছিলেন। তাঁর ডায়রিতে পাওয়া যায় এদেশের কৃষকদের কথা, মাঝিদের কথা। এই ডায়রি পরেই আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন জন। আর ১৯১০ সালে জন তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এমিলির ডায়রি যোগ করে প্রকাশ করেছিলেন ‘ইন্ডিয়া পাস্ট অ্যান্ড প্রেসেন্ট’।
আরও পড়ুন
ইংল্যান্ডের মাটিতে, তাদেরই হারিয়ে প্রথম অলিম্পিক পদক; সদ্য-স্বাধীন ভারতের ‘প্রতিশোধ’
Powered by Froala Editor