কথায় বলে – ‘সুখ স্বপনে, শান্তি শ্মশানে’। কিন্তু সেই প্রবাদ যদি সত্যি না হয়? শেষ সময়েও যদি না মেলে শান্তি? যদি মন থাকে উচাটন? যদি পাওয়া যায় কোনো অঘটনের 'অশনি সংকেত'? তাহলে তো মহা জ্বালা, মরেও শান্তি নেই!
যেমনটি পাননি শেক্সপিয়র-ও (Shakespeare)। শ্মশানে শান্তি যদি থেকেও থাকে, ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের গোরস্থানে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে, সে শান্তি পারাবার নৈব নৈব চ। মৃত্যুর আগে সেই অস্বস্তিকর, অশান্তির আভাস কি ভালোই টের পেয়েছিলেন তিনি? সেই জন্য শান্তি বিঘ্নকারী, 'কবর খুড়িয়ে'দের উদ্দেশ্যে তিনি ছেড়ে গেছিলেন 'অভিশাপ'? তাতেও কি হয়েছিল শেষ রক্ষা? শান্তি পেয়েছিলেন কি 'বার্ড অফ অ্যাভন'?
১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক শায়ারের স্ট্যাটফোর্ড অন-অ্যাভনে মাত্র ৫২ বছর বয়সে প্রয়াত হন বিশ্বসাহিত্যের সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, নাট্যকার, কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়র। তাঁর মৃত্যুর কারণ কী, তা নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও গবেষক ও ইতিহাসবিদ'রা মনে করেন অত্যধিক মদ্যপানের ফলেই মৃত্যু হয় তাঁর। একরাতে ঘনিষ্ঠ দুই সাহিত্যিক বন্ধু বেন জনসন ও ড্রেইটনের সঙ্গে প্রচণ্ড মদ্যপানের ফলে, অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। প্রায় একমাস শয্যাশায়ী থাকার পর নিভে গেছিল তাঁর জীবন-প্রদীপ। অবশ্য ৫২ বছরের আয়ুর মধ্যে তিনি তাঁর 'পৃথিবী' রচনা করে গিয়েছিলেন যাতে ছিল দেড়শোটিরও বেশি সনেট, ৩৮টি নাটক সহ বহু অবিস্মরণীয় কবিতা।
অসুস্থ থাকাকালীন শেক্সপিয়র লিখে গিয়েছিলেন তাঁর 'এপিটাফ'। ২৩ এপ্রিল ১৬১৬ সালে মৃত্যুর দুদিন পর ২৫ এপ্রিল স্ট্যাটফোর্ড অন-অ্যাভনের হোলি ট্রিনিটি চার্চে যথাযথ ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। নামহীন সমাধিফলকে খোদিত করা হয় সেই বিতর্কিত 'এপিটাফ'।
আরও পড়ুন
শেক্সপিয়রের লেখা শেষ নাটকের সংস্করণ ‘আবিষ্কার’ স্পেনের গ্রন্থাগারে
'Good friend, for Jesus’ sake forbear
To dig the dust enclosed here.
Blessed be the man that spares these stones, And cursed be he that moves my bones.'
আরও পড়ুন
ভারতেই জন্ম, বিবাহ, এমনকি মৃত্যুও – এভাবেই জড়িয়ে পড়েছিল শেক্সপিয়রের পরিবার
এপিটাফের প্রথম দুটি লাইন নিয়ে মন্তব্য নিস্প্রয়োজন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'দাঁড়াও পথিকবর, তিষ্ঠ ক্ষণকাল!' মনে পড়ে যায়। মধু কবি শেক্সপিয়রের থেকেই এপিটাফ লেখার জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কিনা কে জানে! এবার ভালো করে পড়ে দেখুন শেষদুটি লাইন। 'বার্ড অফ অ্যাভন' বলছেন, "প্রিয়বন্ধু, যারা এই সমাধিক্ষেত্রে এসেছেন, ধৈর্য ধরুন। এই সমাধি যারা অক্ষত রাখবেন তাঁদের উপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ ঝরে পড়ুক। কিন্তু যারা এই সমাধিক্ষেত্র নষ্ট বা শবদেহ সরিয়ে অপবিত্র করার চেষ্টা করবে, তারা শাপিত হবেন। তাঁদের কুকর্মের জন্য নেমে আসবে করাল অভিশাপ।"
আরও পড়ুন
প্যারিসের আশ্চর্য বইঘর - শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানি
ভাবা যায়, বিশ্বসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ, শ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকার তাঁর জীবনসায়াহ্নে লেখা শেষ 'সংলাপে' কিনা নির্মল শান্তির বাণী, জীবনবোধ, সাহিত্য বা দর্শনের কারুকাজ তুলে না ধরে এক প্রকার হুমকি দিচ্ছেন, ভয় দেখাচ্ছেন অভিশাপের! এতটাই তিনি অসহায়। অবশ্য তার কারণও ছিল যথেষ্ট।
সেই সময়ে গোটা ইউরোপ জুড়েই ছিল 'কবর খুড়িয়ে'-দের (Grave-diggers) দৌরাত্ম্য। ইংল্যান্ডে ছিল রীতিমতো রমরমা। কবর খুড়ে শবদেহ তুলে নিয়ে যাওয়া বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সরানোর কাজ চলতো হামেশাই। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জায়গার অভাবেও কবর খুড়ে মৃতদেহ সরিয়ে দেয়া হয়েছে অন্যত্র। এই রীতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন শেক্সপিয়র। তিনি তাঁর 'হ্যামলেটে'ও 'গ্রেভ ডিগার্স'দের কথা উল্লেখ করে ছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পরে তাঁর শবদেহের সঙ্গেও ঘটতে পারে একই ঘটনা, সে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তিনি। শেক্সপিয়র চাননি, মৃত্যুর পর তাঁর দেহাংশ নিয়ে টানাহেঁচড়া হোক। আর সে জন্যই বুঝি এই 'সতর্কবার্তা'- কবর খুঁড়লেই অভিশাপ, তাই সাধু সাবধান!
তাঁর এই প্রচ্ছন্ন হুমকি কাজে দিয়েছিল। মনে করা হয় যে প্রায় ৪০০ বছর অক্ষত ছিল শেক্সপিয়রের সমাধি। কিন্তু সেই তত্ত্বও ভুল প্রমাণিত হয়েছে সম্প্রতি। ২০১৬ সালে শেক্সপিয়রের ৪০০তম মৃত্যুতিথিতে পুরাতাত্ত্বিক বিজ্ঞানীদের একটি দল অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারেন, শেক্সপিয়রের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। 'হাই রেডিয়েশন র্যাকডার' চালিয়ে তারা দেখেন শেক্সপিয়রের সমাধি থেকে খোয়া গেছে তার মুণ্ডটি। শোরগোল পড়ে যায় সারা পৃথিবীতে। গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বলেন, এই কুকাজটি সম্পন্ন হয়েছে বহু আগে, উনবিংশ শতাব্দীতেই। শুরু হয় অনুসন্ধান, ইতিহাস ঘেঁটে, বিস্তর নথিপত্র উল্টে তত্ত্ব তালাশ। জানা যায়, এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।
১৮৭৯ সালে অর্গোসি ম্যাগাজিনে প্রথম বেরোয় এই খুলি উধাও রহস্যের কথা। প্রতিবেদনে জানা যায় ধরা পড়েছিল এক অভিযুক্ত-ফ্র্যারঙ্ক চেম্বার্স। জেরার মুখে এই দুষ্কর্মের কথা নাকি সে স্বীকার করেছিল। বলেছিল, মাত্র ৩০০ গিনির বিনিময়ে এক ধনকুবের 'বোন কালেক্টরে'র জন্য সমাধি খুঁড়ে সে উঠিয়ে এনেছিল শেক্সপিয়রের করোটি। কিন্তু তারপরেই অভিশাপের কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে চেম্বার্স। শেক্সপিয়রের করোটি সে নিকটবর্তী বিওলে-র সেন্ট লিওনার্ড'স চার্চে লুকিয়ে রেখে এসেছিল। অনুসন্ধানকারী টিম ওয়ারচেস্টারশায়ারের বিওলে গ্রামের সেই প্রাচীন চার্চে হানা দেন, এবং আশ্চর্য একটি করোটি উদ্ধারও করেন। কিন্তু পরীক্ষা চালিয়ে জানা যায়, সেটি এক সত্তর বছরের মহিলার করোটি। শেক্সপিয়রের নয়। শুধু রয়ে গেছে প্রশ্ন - কোথায় গেল শেক্সপিয়রের মাথা? আজও তা রহস্য!
পাক্কা ৪০৫ বছর আগে আজকের দিনেই প্রয়াত হয়েছিলেন 'বার্ড অফ অ্যাভন'। তাঁর স্মৃতিতেই পালন করা হয় 'বিশ্ব বই দিবস'। আজও হোলি ট্রিনিটি চার্চে স্ত্রী আনে হ্যাথওয়ের কবরের পাশে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন তিনি। ঠিক বললাম কি? সত্যিই কি নিশ্চিন্তে আছেন শেক্সপিয়র? কেই বা তা বলতে পারে! তার 'অভিশাপে' কাজ দেয়নি, নষ্ট হয়েছে তাঁর সমাধির পবিত্রতা, মুণ্ডহীন শুয়ে আছেন চারশো বছর। আজও খোঁজ চলছে তাঁর করোটির, গড়ে উঠছে রহস্য, চলছে গবেষণা, জল্পনা, বিতর্কের পাহাড়। অনায়াসে যা নিয়ে লেখা যেতে পারে আস্ত একটা রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ বা হলিউডি সাসপেন্স-থ্রিলার। হয়ে উঠতে পারে একবিংশ শতকের সেরা খোঁজ। বাকিটা সময়ের হাতে।
তবু শেক্সপিয়র, শেক্সপিয়র-ই। মাথা থাক বা না থাক, তাঁর বিকল্প নেই। সমস্ত জল্পনা কল্পনার ঊর্ধ্বে 'হ্যামলেট'-র মুখ একমাত্র তিনিই বলাতে পারেন, তাঁরই স্বগতোক্তি -
'To be, or not to be, that is the question:
Whether 'tis nobler in the mind to suffer
The slings and arrows of outrageous fortune,
Or to take arms against a sea of troubles...'
Powered by Froala Editor