আজ থেকে প্রায় ১৬ বছর আগে মালয়ালি ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল একটি বই। বছরখানেকের মধ্যে ইংরেজি সহ বেশকিছু ভাষায় অনূদিত হয়ে সেই বই ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। বইটি ছিল এক যৌনকর্মীর আত্মজীবনী। আর লেখিকার নাম নলিনী জামিলা। কেরালার ত্রিশূর শহরের একটি যৌনপল্লী থেকে উঠে আসা নলিনী পরে হয়ে উঠেছিলেন নারীবাদী ও লিঙ্গসাম্য আন্দোলনের এক পরিচিত মুখ। আর এবার আরও এক সম্মান পেলেন তিনি। কেরালার রাজ্য চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচ্ছদশিল্পী হিসাবে মনোনীত হলেন নলিনী (Nalini Jameela)।
চলতি বছরেই মুক্তি পেয়েছে দক্ষিণের জনপ্রিয় পরিচালক মণিলালের সিনেমা ‘ভারতপূজা’। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রটি একজন যৌনকর্মীর। আর সেই চরিত্রটির পোশাক ও অন্যান্য সাজসজ্জার বিষয়টি দেখেছেন নলিনী। এই প্রথম সিনেমার জগতে পা রাখা তাঁর। আর প্রথমবারেই বাজিমাত করলেন তিনি। অবশ্য এমনটা তো হওয়ারই ছিল। যে জীবন তিনি নিজে দেখে এসেছেন, দীর্ঘদিন যে জীবনে কাটিয়ে এসেছেন, তাকেই পর্দার উপযোগী করে তুলে ধরেছেন তিনি।
কেরালার কাল্লুর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে ১৯৫৪ সালে জন্ম নলিনী জামিলার। সেই সময় গ্রামে লেখাপড়ার পরিবেশ বলতেই কিছু ছিল না। মহিলাদের ক্ষেত্রে তো নয়ই। তবুও কোনোরকমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন নলিনী। গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী বেশ কম বয়সেই বিবাহ হয়েছিল তাঁর। কিছুদিনের মধ্যেই দুই কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন। কিন্তু হঠাৎই তাঁর স্বামীর ক্যানসার ধরা পড়ে। একরকম বিনা চিকিৎসাতেই হারিয়েছেন স্বামীকে। আর তারপর নলিনীর গোটা জীবনটাই একটা সংগ্রাম। সংসার চালাতে প্রথমে ইঁটভাটায় এবং পরে গৃহপরিচারিকার কাজও করেছেন তিনি। কিন্তু তাতে যা রোজগার হত, দুই সন্তান নিয়ে কিছুতেই সংসার চলত না তাতে। এদিকে যুবতী বিধবার দিকে সবসময় দুর্বৃত্তদের লোলুপ দৃষ্টি ছিলই। শেষ পর্যন্ত তাই যৌনপল্লীতেই নাম লেখালেন তিনি।
এর পরের কাহিনি নিয়েই ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘একজন যৌনকর্মীর আত্মজীবনী’। কাহিনির ছত্রে ছত্রে তিনি তুলে ধরেছেন যৌনপল্লীর দালালদের সঙ্গে বিরোধের ঘটনা, পুলিশের অত্যাচারের ছবি – এমনই নানাকিছু। নলিনী জামিলার এই বই রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। কার্যত তাঁর নেতৃত্বেই এরপর কেরালার যৌনকর্মীদের আন্দোলন গড়ে ওঠে। তবে এটাই যৌনপল্লীর সার্বিক দৃশ্য নয়। ২০১৮ সালে আরও একটি বই লিখেছেন নলিনী। যৌনকর্মীদের জীবনেও কীভাবে প্রেম আসে, তাই তুলে ধরেছেন সেখানে।
আরও পড়ুন
২ লক্ষাধিক শিশুর যৌন নিগ্রহ গির্জায়! তদন্তে তোলপাড় ফ্রান্স
নানারকম সামাজিক কাজের সূত্রেই পরিচালক মনিলালের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল নলিনীর। আর তাই তাঁর অনুরোধ ফেরাতে পারেননি। তবে এতদিন আগে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি আবার নতুন করে জাগিয়ে তুলতে বেশ কষ্টই পেতে হয়েছে তাঁকে, জানিয়েছেন নলিনী। তিনি শুধু যে সিনেমায় পোশাক-পরিচ্ছদের দায়িত্ব সামলেছেন, তাই নয়। অভিনেত্রী সিজি প্রদীপকে ম্যানারিজমের জায়গাগুলিও বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে নলিনী জামিলার অবর্তমানে ‘ভারতপূজা’ কখনোই সম্পূর্ণ রূপ পেত না। তবে এরপর সিনেমার জগতে আর কাজ করবেন কিনা, তা নিজেও জানেন না নলিনী। তিনি জানিয়েছেন, সারা জীবন নানা ধরনের কাজ করেছেন তিনি। কোনো কাজকেই ছোট বা বড়ো হিসাবে দেখেননি। আজও তাই কোনো কাজই তিনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। তাছাড়া, তাঁর আত্মজীবনী নিয়েও একদিন সিনেমা হবে, এমন একটা ইচ্ছা তো রয়েছেই।
আরও পড়ুন
জার্মানির ডক-লিপজিগ তালিকায় কালীঘাটের যৌনপল্লি নিয়ে তৈরি সিনেমা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
যৌনকর্মীদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, ‘হিটলিস্ট’ তৈরি তালিবানদের