নীলচে সবুজ তিস্তার স্রোত। তার দু’পাশ বরাবর পাহাড়। বন, পাখি, রঙিন জীববৈচিত্র। এসব আর থাকবে না কিছুই। তার বদলে বড় রেলগাড়ি ছুটবে পাহাড়ের বুক চিরে। খবরের চ্যানেলে জোরকদমে প্রচার শুরু হয়েছে, দু’বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ হবে সেবক-রংপো রেললাইন। দু’ঘণ্টায় পৌঁছনো যাবে সিকিম! শুনেই শিরশিরানি জাগবে আমাদের ট্যুরিজম-লিপ্সায়। ওদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে জেসিবি, বুলডোজার উঠছে। পাহাড় ফাটিয়ে, গুঁড়িয়ে, বন ভ্যানিশ করে দিয়ে ‘উন্নয়ন’ শুরু হয়ে গেছে।
ভারতীয় রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সিকিমকে জুড়বে সেবক থেকে রংপো রেলপথ। তারপর, সম্ভবত রংপো থেকে গ্যাংটক। অরণ্য, অরণ্যবাসীদের নিকেশ হলে ক্ষতি নেই। দুয়ার খুলে যাবে বাণিজ্যের, মিলিটারি চলাচলের, ট্যুরিজমের। তাই মমতা, মোদী দুজনেরই স্বপ্নের প্রকল্প এটি। মুনাফা প্রকৃতির চেয়ে বড়।
নর্থইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ে উত্তরবঙ্গের সেবক থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত এই ব্রডগেজ রেললাইন পাততে চলেছে। মাথায় রাখুন, টয় ট্রেন নয়, ছুটবে পেল্লায় রেলগাড়িই। ২০০৮ সালে এই প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার পর ২০০৯ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। প্রস্তাবিত এই প্রকল্পে রেললাইন যাবে তিস্তা নদীর গা ঘেঁষে কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশ বরাবর। খাড়া পাহাড়ি এই অঞ্চল স্বভাবতই ভূমিকম্প প্রবণ (seismic zone IV)। বর্ষায় (মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত) ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত যুক্ত এই অঞ্চল ধ্বসপ্রবণও।
অরণ্য, অরণ্যবাসীদের নিকেশ হলে ক্ষতি নেই। দুয়ার খুলে যাবে বাণিজ্যের, মিলিটারি চলাচলের, ট্যুরিজমের।
কার্শিয়াং, দার্জিলিং, কালিম্পং, ইস্ট সিকিম ফরেস্ট ডিভিশন ও মহানন্দা অভয়ারণ্যের বনাঞ্চল জুড়ে প্রস্তাবিত এই রেলপথের প্রায় ৮০% জুড়েই থাকবে ১৪টা ছোট-বড় টানেল [বলা হচ্ছে পাহাড় ফাটিয়ে টানেল তৈরিতে কাজে লাগানো হবে New Austrian Tunneling Method (NATM)। ১৯৬০ এর দশক থেকে উন্নয়ন-বিশ্বে বহুল প্রচলিত এই প্রযুক্তি দেশে-দেশান্তরে ভৌমজল ভাণ্ডারে দূষণ ঘটিয়ে এসেছে।] টানেল-মুখ তৈরি করার ফলে অগুন্তি বিস্ফোরণ, গাছ-কাটা, খনন কাজ, খুঁড়ে তোলা মাটি, পাথরের ডাঁইতে বিদ্যমান আঞ্চলিক পরিবেশের সমূহ ক্ষতি হবে। শুধু তাই নয়, দৈত্যাকার টানেলগুলো তৈরি করার ফলে গোটা অঞ্চলের ভূগাঠনিক ব্যবস্থাটাই বড়সড় নড়াচড়ার মধ্যে পড়বে, ভৌমজলস্তরে রদবদল ঘটাবে। মাটি দূষণ, গুরুতর ভূমিক্ষয় ঘটাবে, সবমিলিয়ে সমগ্র প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রই ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তাছাড়া, প্রকল্পে ব্যবহৃত অগুনতি ডিজেল ইঞ্জিনের কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, প্রকল্প এলাকায় ব্যবহৃত কংক্রিট, সিমেন্ট, পাথর, সিলিকা, যানবাহনের বিষ, ধোঁয়া-ধুলো-গ্যাস মিশে বিষাক্ত হাওয়া উপহার দেবে৷ টানেল খোঁড়ার বিস্ফোরণের শব্দে, ড্রিলিং মেশিন, যন্ত্রপাতি, নির্মাণ সংক্রান্ত পরিবহনের শব্দে, টানেল ভেন্টিলেশনে ব্যবহৃত ফ্যানের শব্দে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সেবক থেকে রংপো রেল চলাচল শুরু হ’লে নতুন ক’রে এই স্পর্শকাতর প্রাকৃতিক অঞ্চলে হত্যালীলা শুরু হবে।
নির্মীয়মান প্রকল্প এলাকা থেকে ভয়ঙ্কর দূষক ডিজেল, তেল, বিষাক্ত রাসায়নিক, সালফেট, সিমেন্ট ইত্যাদি আঞ্চলিক জলধারা, জলা, জলাজমিতে মিশেও জলজ বাস্তুতন্ত্রের সর্বনাশ করবে। পানীয় জলে সংক্রামিত হবে বিষ।
পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের প্রকৃতি বিপুলা। ক্রান্তীয় থেকে পার্বত্য ধরনের - অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল এখানকার পাহাড়-জঙ্গল। ওষধি গাছ (প্রায় দু’হাজার প্রজাতির), অর্কিড, ফার্ন, ম্যাগনোলিয়া, লাইকেন, শতাধিক প্রজাতির বাঁশ, রডোডেনড্রন থেকে অজস্র পাখি (পাঁচ শতাধিক প্রজাতির), প্রজাপতি, মথ (অধিকাংশই বিপন্ন প্রজাতি বর্গভুক্ত), মাছ, পিপীলিকাভুক প্যাঙ্গোলিন, তিব্বতি বুনো গাধা, তিব্বতি ভেড়া, শেয়াল, বাঘরোল (fishing cat), বনবিড়াল, লিংস্যাং, মাস্ক ডিয়ার, চিতল, বাইসন, তুষার চিতা, টাইবেটান নেকড়ে, হাতি, বাঘ ইত্যাদি অসংখ্য প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বাস এই অঞ্চলে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে সেবক পর্যন্ত রেলপথে ট্রেনের ধাক্কায় অনেক বাইসন, চিতা, হাতির প্রাণ গেছে। এখানে রয়েছে হাতির পরিযানের (migration) পথ। বর্ষায়, শীতে মহানন্দা বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যে আশ্রয় নেয় প্রায় দেড়শতাধিক হাতি। তাই সেবক থেকে রংপো রেল চলাচল শুরু হ’লে নতুন ক’রে এই স্পর্শকাতর প্রাকৃতিক অঞ্চলে হত্যালীলা শুরু হবে।
বনগ্রামবাসীরা তাদের জমি এই মারণ প্রকল্পের জন্য ছাড়তে চাইছেন না। তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই জমিতে চাষ-বাস করে এসেছেন, অথচ জমির উপরে তাঁদের আইনি অধিকারটুকুও দেওয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে।
এসবের মধ্যেই গত বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে ব্লাস্টিং-এর কাজ শুরু হয়েছে। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, এই উন্নয়নের শরিক হতে না চাইলে পাহাড়ের গ্রামে গ্রামে গুন্ডারা এসে শান্তির বাণী শোনাচ্ছে, লোভ দেখানো হচ্ছে টাকারও। গত ২৯ তারিখ ভালুখোপ গ্রাম যাওয়ার পথে তিস্তার গায়ে মেল্লি গ্রামে গাদাগুচ্ছের জেসিবি মেশিন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন রেলের কন্ট্রাক্টররা, কোনওরকম অনুমতি ব্যতিরেকে তাঁদের গ্রামে এই ধ্বংসাত্মক প্রকল্পের কাজ শুরু হ’তে চলেছে দেখে মেল্লি গ্রামের সাধারণ বাসিন্দারা কাজ আটকে দিয়েছেন। সরকারি কাজে বাধা দেওয়া তা’বলে - কী সাহস বলুন তো!
এই প্রজেক্টের জন্য প্রয়োজন ৯৮.৯৪ হেক্টর জমি। যার মধ্যে ২.৭৭ হেক্টর জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন। ১৮.৪ হেক্টর সরকারি খাসজমি ও প্রায় ৮.৪৯ হেক্টর জমি বন দপ্তরের আওতাধীন। বনের জমি অধিগ্রহণের জন্য রেল এখনো ছাড়পত্র পায়নি। ‘বন অধিকার আইন’ মোতাবেক, যতক্ষণ পর্যন্ত এলাকার বননির্ভর বনবাসী মানুষদের যাবতীয় বনাধিকারের দস্তাবেজ না তৈরি হচ্ছে, এবং সে কথা লিখিত ভাবে জানাচ্ছেন স্থানীয় গ্রামসভাগুলো, সে ছাড়পত্র দেওয়া যাবে না।
এই উন্নয়নের শরিক হতে না চাইলে পাহাড়ের গ্রামে গ্রামে গুন্ডারা এসে শান্তির বাণী শোনাচ্ছে, লোভ দেখানো হচ্ছে টাকারও।
৭৭.৭৭ হেক্টর জমিতে রয়েছে বনগ্রামগুলি। এবং বনগ্রামবাসীরা তাদের জমি এই মারণ প্রকল্পের জন্য ছাড়তে চাইছেন না। তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই জমিতে চাষ-বাস করে এসেছেন, অথচ জমির উপরে তাঁদের আইনি অধিকারটুকুও দেওয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। স্থানীয় বনগ্রামবাসী, বনগ্রামবাসীদের অধিকার আন্দোলনকর্মীরা বলছেন এই প্রকল্প হলে বন অধিকার আইনের (২০০৬) লঙ্ঘন হবে। এই আইন অনুসারে বন ও বন পার্শ্বস্থ এলাকায় কোনও প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বনগ্রামসভার সম্মতি নিয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করা যায়। যদিও এই আইন মোতাবেক কোনো ব্যবস্থাই সরকারি উদ্যোগে নেওয়া হয়নি। ২০১১ সালে স্থানীয় ২৪টা বনবস্তিতে গ্রামবাসীদের উদ্যোগে আইনি প্রক্রিয়া মেনেই গ্রামসভা গঠনের কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু GTA (Gorkhaland Territorial Administration) তাকে মান্যতা দেয়নি। এমতাবস্থায়, এই প্রকল্পের জন্য গ্রামবাসীদের থেকে জড় করে জমি কাড়তে পারে সরকার, ভয় থাকছেই।
তিস্তাকে ঘিরে থাকা জীববৈচিত্রের অনেকখানি এমনিতেই ধ্বংস হয়ে গেছে ড্যামের দাপটে। সেই হত্যালীলা এবারে ঘটবে রেললাইন প্রকল্পের নামে। পৃথিবীতে কার্বন বাড়ছে, দূষণ বাড়ছে, এই গ্রহের আয়ু ফুরোচ্ছে আর কখনও ‘উন্নয়ন’, কখনও ‘বিকাশ’-এর নামে প্রকৃতি ধ্বংস করে চলছে ‘উন্নয়ন’।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)