‘শুভ, কেমন আছো?’
পরিচালনা – পার্থপ্রতিম চৌধুরী
প্রযোজনা – ক্যানভাস
সাল – ১৯৭৮
ভিনসেন্ট ভ্যান গঘকে নিয়ে ২০১৮ সালে একটি ইংরেজি ছবি মুক্তি পেল, ‘অ্যাট ইটারনিটি’জ গেট’ ছিল ছবির নাম। তার আগের বছর, ২০১৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল একটি অ্যানিমেটেড ছবি ‘লাভিং ভিনসেন্ট’ নামে। হ্যাঁ, ভ্যান গঘকে নিয়ে জীবনীচিত্রের চল প্রচুর। কির্ক ডগলাস অভিনীত ‘লাস্ট ফর লাইফ’ (১৯৫৬) ছবিটি অনেকের মনে থাকবে, উন্মাদপ্রায় শিল্পীর আকুতি চমৎকার ফুটেছিল সেখানে। পশ্চিম দেশেই শুধু নয়, জাপানের কিংবদন্তী ছবি-করিয়ে আকিরা কুরোশাওয়া ‘ড্রিমস’ ছবির একটি পর্ব তুলেছিলেন ভিনসেন্টকে নিয়ে। উনিশ শতকের এই চিত্রকর জীবনে তেমন খ্যাতি বা সমাদর কিছুই পাননি, আঁকা ছবিও বিক্রি হয়নি, একটি ছবিই কেবল কিনেছিলেন জনৈকা মহিলা। দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন ফ্রান্সের মানসিক হাসপাতালে, ছবি আঁকায় তখনও ছিল না বিরতি। মারা যান উন্মাদ অবস্থায়, আত্মহত্যা করে। বর্ণময়, নাটকীয়, ট্র্যাজিক জীবনের কারণে ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ বরাবরই রুপোলি পর্দার আইকনিক মুখ হয়ে থেকেছেন।
বাংলা ভাষায় ১৯৭৮ সালে একটি ছবি হয়েছিল, যেটি এখন প্রায় বিস্মৃত, অনেকেই দেখেননি। ছবির নাম ছিল ‘শুভ, কেমন আছো?’, পরিচালক ছিলেন পার্থপ্রতিম চৌধুরী। ছবিটি সর্বার্থেই ছিল স্বাধীন চলচ্চিত্র। প্রযোজনা করেছিল ‘ক্যানভাস’ গোষ্ঠী, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেন নাম ভূমিকায়। ‘শুভ’ অর্থাৎ শুভব্রত ছিল একজন তরুণ চিত্রকর, যে প্যারানোইয়া ও বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি-র অসুখে ভুগছিল অনেকদিন। মা ও দাদার মধ্যবিত্ত সংসারে তার অস্তিত্ব এক জ্যান্ত অভিশাপের মতো। না, ইউরোপীয় শিল্পী নিজের চরিত্রে আসেননি, কিন্তু সত্তর দশকের এই শুভব্রতের মধ্যে যেন ভর করে থেকেছে ভ্যান গঘের প্রেত!
শুভব্রত কেন মানসিক অসুখে ভুগছিল, কেন দিনের পর দিন অল্পে অল্পে এগিয়ে যাচ্ছিল পাগলামির দিকে? তার কারণ অনেকগুলি হতে পারে। এমনও হতে পারে যৌন হতাশা ও অবদমন কুরে কুরে খেয়েছিল তাকে। হয়তো তার অতি-সচেতন চোখ দেখে নিয়েছিল সর্বস্তরে দুর্নীতির ছবি, পচনের ক্ষত। যে সময়টা সে জন্মসূত্রে পেরিয়ে এসেছে, তা বড় সুখের ও বড় আনন্দের সময় ছিল না। দেশভাগ-উত্তর ভারতবর্ষে কিছু তরুণ দেখেছিল বিপ্লবের স্বপ্ন, চেয়েছিল যাতে সত্তর দশক মুক্তির দশক হয়ে ওঠে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের রক্তমাখা স্মৃতিই কি তবে পেড়ে ফেলেছিল শুভব্রতকে?
শুভব্রতের দেওয়াল জুড়ে আমরা বারবার দেখতে পাই রাক্ষসের অবয়ব, সন্ত্রাসের ছবি, যেন এ-ই তার ব্যক্তিগত গুয়ের্নিকা, আত্মার গ্রাফিত্তি! সে যেন বলতে চায় ডিসটোপিক সময়ের ছবিও হবে ডিসটোপিক, কেননা আজ ফুল খেলবার দিন নয়, ধ্বংসের মুখোমুখি শিল্পী কেবল পাগলামিই উৎপাদন করতে পারে। তার বিবেকই তাকে ভেঙেচুরে করে তোলে অসুস্থ সময়ের শরীরী সত্তা। শ্রীযুক্ত জেকিলের ভেতরের নির্লজ্জ দানবটি বেরিয়ে আসে।
ভ্যান গঘের ক্যানভাসে ল্যান্ডস্কেপ শুধুই নিসর্গের অনুকরণ হয়ে থাকেনি, বরং শিল্পীরই হাহাকার ব্রাশের হিংস্র টানে, রঙের প্রলেপে ফুটেছিল - এক অর্থে তার ল্যান্ডস্কেপ ছবিগুলি ছিল যেন তারই প্রতিচ্ছায়া। ভ্যান গঘ বা এল গ্রেকোর মতো মহৎ শিল্পী যা-ই আঁকেন, তা হয়ে ওঠে সেলফ পোর্ট্রেট, কথাটা বলেছিলেন সিনেমা-তাত্ত্বিক সের্গেই আইজেনস্টাইন। শুভব্রতের ছবি আর শুভব্রত তাই আলাদা কিছু নয়, তার ব্যক্তিগত দুঃস্বপ্ন একদিন ছেয়ে ফেলবে শহর কলকাতার সমস্ত দেওয়াল!
অগোছালো, খরখরে ছবিটি ভিন্ন ভিন্ন ফর্মকে একসঙ্গে ধরে রাখতে চেয়েছিল। শুভব্রত প্রায়ই একটি অভয়ারণ্যের স্বপ্ন দেখত, যেখানে পশুর কস্টিউম পরা মূর্তিরা হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে হেঁটে বেড়ায়, যে প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকে ‘বিওয়ার অব মেন’, অর্থাৎ ‘মানুষ হইতে সাবধান’। পরাবাস্তব আর বাস্তব ক্রমেই গুলিয়ে যেতে থাকে; আমাদের মনে হয় - শুভ যা কিছু দেখছে তার সবটাই কি বিভ্রম? তার রূপসী প্রেমিকা চরিত্র কি আদৌ বাস্তবিক? তার চারপাশের দাদা, বন্ধু, সাইকিয়াট্রিস্ট, জনতা – এরা কতটা সত্যি, কতটা তার কল্পনা? ...হিংস্র ভিশুয়াল ও মরবিড আঙ্গিক – ছবিটি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে যেন, পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরির উদ্দেশ্যকেই ড্যামেজ করে দিচ্ছে!
বিশ্ব-সিনেমা আয়ত্ত করার চিহ্নগুলি দগদগ করে এখানে – গোদারীয় ধাঁচে ইন্টারভিউ সেশনগুলি তোলা হয়, এডিট করা হয় কোলাজ পন্থায়, অর্থাৎ ন্যারেটিভ ছবির বিপরীত পদ্ধতি মেনে। ফ্রাসোয়াঁ ত্রুফো আবিষ্কৃত ফ্রিজ শটের প্রয়োগ বারবার এসেছে, সমুদ্রতটে নায়িকার সঙ্গে শুভব্রতের প্রেমের ইমেজগুলি ক্রমাগত তাই থমকে যেতে দেখি আমরা। নৈশ কলকাতার নাচের পার্টিতে যখন ঢুকে পড়ে ছবির ক্যামেরা, তখন তার দৃষ্টি হয়ে যায় মাতাল, বীভৎস মজা দেখার রগড়ে অস্থির।
দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া ‘এরা আমারে গাইতে দিল না’ গানটি ছবিতে শোনানো হয়েছে। ইমেজ হিসেবে তখন এসেছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোটোগ্রাফ। বাঙালি শিল্পীর উন্মাদ, উৎকেন্দ্রিক আইকন হিসেবে এই নামগুলোই প্রথমে উঠে আসে। এখানে ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’ সিনেমার একটি ফুটেজও দেখানো হয়, যেখানে মাতাল ‘নীলকণ্ঠ বাগচী’ দূর থেকে হেঁটে আসেন এবং ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স! ফুঃ’ ব’লে বিড়িটি ছুঁড়ে ফেলে দেন। হ্যাঁ, ‘ঋত্বিক ঘটক-কে’, এই উৎসর্গপত্র দেখিয়েই ছবিটি শুরু হয়েছিল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে - নৈরাজ্যের দূত, উন্মাদ ভ্যান গঘ পুনরুত্থিত হন, তিনি কখনো ঋত্বিক ঘটক হিসেবে জেগে ওঠেন, কখনো ব্যর্থ চিত্রকর শুভব্রতের হিজিবিজি আঁকায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর আঙুলের ছাপ! ‘শুভ, কেমন আছো?’ সেই উত্থানেরই এক প্রত্যক্ষদর্শী চলচ্চিত্র-ফলক।