মায়ামি। যুক্তরাষ্ট্র। ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরিয়ে গেলেও যেন রাত নামে না সেখানে। ‘কলির সন্ধে’-জুড়েই চলে হরদম পার্টি, নাচ-গান, খানা-পিনা। সেদিনও রাত হয়েছিল বেশ। রুটিন মাফিকই তিনি হাজির হয়েছিলেন অতিপরিচিত বারে। কয়েকটা চেয়ার পরেই বসে আছেন এক তরুণী। হাতে ধরে থাকা গ্লাসে অল্প অল্প আন্দোলিত হচ্ছে অ্যালকোহল। উঠে গেলেন তিনি। আলাপ জমালেন তরুণীটির সঙ্গে।
কথা গড়াতেই বোঝা গেল চূড়ান্ত হতাশাগ্রস্ত ৩২ বছরের তরুণীটি। নাম মেরী ব্রসলে। পরিবার সরে গেছে তাঁর পাশ থেকে, সেইসঙ্গে সামাজিক চাপ, সম্পর্ক, কর্মক্ষেত্র— সবকিছুই যেন প্রতিকূল পরিস্থিতির দিকেই ঠেলে দিচ্ছে তাঁকে। এক প্রকার এই বেঁচে থাকা যেন দুঃসহ হয়ে উঠেছে তাঁর। এসব জানার পরেও কি চুপ করে থাকা যায়? সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে থাকা যায়? তিনিও তেমনটাই করলেন। আবেদন জানালেন নৈশভ্রমণের। ব্যক্তিগত গাড়িতে করেই তাঁকে নিয়ে গেলেন মায়ামি ২৭ নম্বর রুটের কাছে। নির্জন প্রান্তর। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে কথা চলছে দু’জনের মধ্যে। এমন সময়ই অতর্কিতে ডান হাতে উঠে এল লোহার চেন। মুহূর্তেই তা পেঁচিয়ে গেল তরুণীর গলায়। খানিকক্ষণের মধ্যেই সব নিস্তব্ধ। বন্ধ হৃদস্পন্দন। যাক শান্তি। এই বিষাদ, বিষণ্ণতা, হতাশা থেকে কাউকে মুক্তি দিতে পারলেন তিনি!
স্যামুয়েল লিটল। আমেরিকার কুখ্যাত সিরিয়াল কিলারের প্রথম হত্যাই ছিল সেই ঘটনা। ১৯৭১ সালের সেই রাত্রের পর থেকে পরবর্তী চার দশকে কমপক্ষে আরও ৯৩টি হত্যাকাণ্ড। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তাবড় সিরিয়াল কিলারদের সর্বকালীন রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন লিটল। শুধু মায়ামি নয়, আমেরিকার ১৯টি রাজ্যেই ছড়িয়ে রয়েছে এই নৃশংসতার প্লট।
২০১২ সালে একটি হত্যাকাণ্ডের সময়ই রহস্যভেদ করতে সক্ষম হয় পুলিশ। তখন অবশ্য তাঁর বয়স হয়ে দাঁড়িয়েছে ৭২। মৃত্যুর তালিকা তখন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে গেছে। প্রথমবারের জন্য খুনের অভিযোগে হাজতে গেলেন লিটল। অবশ্য তার আগেও বহুবার চুরি, ডাকাতি, নির্যাতন ইত্যাদি কারণে কারাদণ্ড পেয়েছেন তিনি।
তবে নাগালে পেয়েও পুলিশ জানতে পারেনি, ১৯৭১ সাল থেকেই অব্যাহত ভাবে একের পর এক খুন করে গেছেন লিটল। কারণ কোনো খুনের সময়ই বিন্দুমাত্র প্রমাণ ছেড়ে আসতেন না লিটল। বিগত ২ বছরে চলেছে ৭০০ ঘণ্টারও বেশি জেরা। করা হয়েছে ভিডিও। তবুও হদিশ মেলেনি কিছুরই। সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া জেলে নিজেই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের কথা অকপট স্বীকার করেছেন লিটল। তারপরেই রহস্যোন্মোচন হয় দীর্ঘ চল্লিশ বছরের প্রায় একশোটি খুনের মামলার। সবগুলির পিছনেই ছিল তাঁর হাত। বলাই বাহুল্য, তাঁর স্বীকারোক্তি ছাড়া পুলিশের পক্ষে এই রহস্যভেদ সম্ভবও হত না কখনও।
তাঁর বিবৃতি অনুযায়ীই সম্প্রতি চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে সমস্ত ভিকটিমদের। হুবহু তা মিলেও যায় পূর্ববর্তী পুলিশি নথির সঙ্গে। তবে ৯৩টি ঘটনার বাইরেও আরও বেশ কিছু মানুষকে তিনি হত্যা করেছেন বলে জানান। যা তাঁর বর্তমান স্মৃতির অতলে।
প্রতিটি খুনের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল একটি অদ্ভুত বিশেষত্ব। যাঁদের হত্যা করা হয়েছিল, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে ‘অযাচিত’ সমাজের কিংবা নিজেরাই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন নিজেদের জীবন নিয়ে। তাঁর বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ছিল যৌনকর্মী, গৃহহীন, মাদকসেবী এবং মাদক-পাচারকারীরা। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। সঠিক করে বলতে গেলে সংখ্যাটা ৬৮। তাঁদের অধিকাংশেরই সম্পর্ক নেই পরিবারের সঙ্গে, নেই কোনো আত্মীয়ও। ফলে পারিবারিক তাগাদায় সেইভাবে অনুসন্ধানও করেনি কেউ।
১৯৪০ সালে আটলান্টার থেকে ১০০ মাইল দূরের ছোট্ট শহর রেনল্ডসে জন্ম স্যামুয়েল লিটলের। শ্বেতাঙ্গ মায়ের কৃষ্ণাঙ্গ সন্তান। তা ছাড়াও আঠারোর গণ্ডি যে পার করেননি তিনি। কাজেই সন্তানকে কার্যত দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন তাঁর মা। বড় হয়ে ওঠা আত্মীয়দের কাছে। সেখানেও বজায় ছিল ‘অপ্রত্যাশিত’-এর ট্যাগ। ছোট থেকেই এই একঘেয়ে জীবন থেকে পালিয়ে মুক্তির সন্ধান করেছিলেন স্যামুয়েল। সম্ভব হয়নি।
তখন পঞ্চম শ্রেণী। প্রথমবারের জন্য এক শিক্ষকের আচরণে কিশোরী বান্ধবীকে দেখেছিলেন নির্যাতিত হতে। হত্যার তাগিদ মনে জেগে উঠেছিল সেই সময়ই। ভেবেছিলেন শ্বাসরোধ করেই থামিয়ে দেবেন বান্ধবীর জীবন। তারপর তাঁকে এই নোংরা পৃথিবী থেকে মুক্ত করে দেবেন চিরতরে। সেদিনের সেই কিশোর স্যামুয়েলকে সেই ঘটনার সাক্ষী না থাকলে হয়তো তাঁর মধ্যে কোনোদিনই জেগে উঠত না হত্যাস্পৃহা। প্রাণ যেত না এতগুলো মানুষের। এও যেন এক ভাগ্যের পরিহাস। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের পিছনে খানিকটা হলেও সেক্ষেত্রে দায় থেকেই যায় এই সমাজের। যা স্যামুয়েলকে বানিয়ে তুলেছে নৃশংস, নির্মম। শিখিয়েছে একমাত্র মৃত্যুই মুক্তির অর্থ...
Powered by Froala Editor