বাংলা আর ওড়িশার সম্পর্ক আজকের নয়। একটা সময় একসঙ্গেই ছিল এই দুই রাজ্য। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভ্রমণ - এইসবের মধ্যে দিয়েই আমাদের যাতায়াত। এরই মধ্যে একজন মানুষ ছিলেন, যিনি সাহিত্যকেই বাংলা-ওড়িশার সেতু হিসেবে ভেবেছিলেন। তৈরি করেছিলেন সেই সাঁকো। বাংলার অনেক লেখাকে নিজের অনুবাদের মাধ্যমে ওড়িশার পাঠকদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। আবার উল্টোটাও করেছেন। তিনি, সাহিত্য অকাদেমি প্রাপ্ত সাহিত্যিক যুগলকিশোর দত্ত। সম্প্রতি চলে গেলেন তাঁর সমস্ত কাজ ছেড়ে।
ওড়িশাই তাঁর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্র। ১৯২৮ সালে পুরীতে জন্ম হয়েছিল যুগলকিশোরবাবুর। লেখালেখির শুরু কলেজ জীবন থেকেই। তারও আগে থেকে শুরু বই পড়া। ওড়িয়া বই তো ছিলই, বাংলাও ছিল সেই তালিকায়। মূলত গোয়েন্দা গল্প। অন্যান্য বইও ছিল। সেই সঙ্গে চলছিল নিজের সাহিত্য-যাপন। ১৯৪৮ সাল। তখন থেকেই ওড়িয়া ভাষায় কবিতা লেখার শুরু। বন্ধুদের নিয়ে চালু করলেন একটি পত্রিকা, নাম ‘দিগন্ত’।
আরও পড়ুন
বাড়ি কিনবেন গুলজার, ডাউন পেমেন্ট করলেন কোন বাঙালি?
সেই সময়ই আলাপ লক্ষ্মীকান্ত মহাপাত্র’র সঙ্গে। ওড়িশার অন্যতম প্রথিতযশা কবিও যে ওঁর কবিতা পড়েছেন! পড়ে প্রশংসাও করছেন! এ যেন অভূতপূর্ব মুহূর্ত ছিল তরুণ যুগলকিশোরের কাছে। আরও পড়তে শুরু করলেন, আরও ডুবতে শুরু করলেন নিজের মধ্যে। সেই সঙ্গে জারি থাকল লেখা। ১৯৫০ সালে বের হল তাঁর প্রথম কবিতার বই, ‘শতাব্দীর প্রেম’।
মানুষের জীবনে এক এক সময় এক এক রকম বাঁক আসে। কেউ হারিয়ে যায়, কেউ প্রবলভাবে বেঁচে ওঠে। এরকমই একটি বাঁক এল যুগলকিশোরের জীবনে। নজর পড়ল অনুবাদ সাহিত্যের দিকে। এরই মধ্যে কটকে তাঁর সঙ্গে দেখা হল ওড়িশার অন্যতম প্রধান অনুবাদক লক্ষ্মীনারায়ণ মোহান্তি’র সঙ্গে। তিনিও বাংলা থেকে ওড়িশাতেই অনুবাদ করেতেন। সেখান থেকেই উৎসাহ পেলেন যুগলকিশোর। তারপর থেকেই কাজ শুরু হয় তাঁর। ১৯৭০ সালে বিমল মিত্রের ‘আমেরিকা’-র অনুবাদ দিয়ে শুরু হয় এই নতুন যাত্রা। তারপর থেকে ৯৬টি বাংলা বইয়ের অনুবাদ করেছেন তিনি। বিমল মিত্র তো বটেই, রবীন্দ্রনাথ, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তসলিমা নাসরিন-সহ আরও বহু লেখককে ওড়িশার পাঠকদের সানে নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
প্রেম হোক বা সন্তানশোক, রবীন্দ্রনাথের মতো নিজেকে আড়াল করেননি নজরুল
এই অনুবাদই তাঁকে এনে দেয় একের পর এক সম্মান। বিমল মিত্রেরই আরেকটি উপন্যাস ‘আসামি হাজির’-এর ওড়িয়া অনুবাদের জন্য ১৯৯৭ সালে পেলেন সাহিত্য অকাদেমি সম্মান। সেই বছরই পেলেন ওড়িয়া সাহিত্য অকাদেমি সম্মানও। সম্ভবত তিনিই এখনও অবধি একমাত্র লেখক যিনি একই বছরে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্মান পেয়েছেন। এ যে এক বিরল সম্মান!
অনুবাদের সূত্রেই যুগলকিশোরের সঙ্গে যোগাযোগ অমর মিত্রের। তাঁর সাহিত্য অকাদেমি প্রাপ্ত উপন্যাস ‘ধ্রুবপুত্র’-এর ওড়িয়া অনুবাদ করেন তিনি। যুগলকিশোর দত্তের মৃত্যুর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের স্মৃতিচারণায় সেই অভিজ্ঞতারই উল্লেখ করেছেন স্বয়ং অমর মিত্র। সেই সময় রীতিমত বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন মানুষটির পরিশ্রম দেখে। তখনই তাঁর বয়স ৮০ পেরিয়েছে। কানেও কম শুনছেন। সঙ্গে বার্ধক্যের অন্য থাবা তো আছেই। তাও দমে থাকেননি এই মানুষটি। সাহিত্যকে লেখাকে ভালোবেসে, সেই কাজ সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছিল তাঁর সর্বক্ষণের। অসুস্থ অবস্থাতেও তাঁর কলম থামেনি। অবশেষে মৃত্যু এসে থামিয়ে দিল ৯২ বছরের মানুষটির নিঃশ্বাস। বাংলা-ওড়িশার সাহিত্যের একটি সেতু যেন চলে গেল…