জলবায়ু পরিবর্তনের জের, ঘাসের খোঁজে উদভ্রান্ত পশুপালকরা

গাধার পিঠে চাপানো জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সামান্য কিছু সামগ্রী, কিছু শুকনো খাবার। তার পিছনে দু-তিনটে গরুর গাড়ি। তাতে বোঝাই গোটা কুড়ি ছাগল ও ভেড়া। তবে প্রত্যেকটি পশুর শরীরই জীর্ণ। দেখেই বোঝা যায় বহুদিন ঠিকমতো খাবার জোটেনি তাদের। কিন্তু গবাদি পশুর এই বিশাল পাল নিয়ে কোথায় চলেছে তরুণ পশুপালকরা (Cattle Herders)?

সম্প্রতি এমনই ছবি ধরা পড়ল সেনেগালের (Senegal) উত্তর সাহেলিয়ান অঞ্চলে। পশুদের খাদ্যের সন্ধানে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে সেখানকার পশুপালকদের। জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন যে কতটা বিপর্যস্ত করে তুলছে প্রান্তিক মানুষদের জীবন— এই দৃশ্য তারই প্রতীক। 

শুষ্ক শীত ও গ্রীষ্মের পর জুলাই মাসে সামান্য বৃষ্টির স্বাদ পায় সেনেগাল। সবুজ হয়ে ওঠে সেনেগালের চারণভূমিগুলি। সরু নালার মতো নদীগুলিই ভরে ওঠে কানায় কানায়। কিন্তু বিগত চার-পাঁচ বছরে প্রকৃতির এই সাদামাটা নিয়মই যেন বদলে গেছে হঠাৎ করে। বৃষ্টি নেই এক ফোঁটাও। এক বছর, দু-বছর নয় একটানা চারটে মরশুম বৃষ্টির অপেক্ষাতেই কেটে গেছে সে-দেশের পশুপালকদের। এদিকে শুকিয়ে কাঠ উত্তরের তৃণভূমিগুলি। ফলে বাধ্য হয়েই, পশুর দলবল নিয়ে দেশের দক্ষিণে দৌড়াতে হচ্ছে পশুপালকদের।

তবে সেটাও খুব একটা সহজ কাজ নয়। প্রথমত, এই বিপুল সংখ্যক পশু নিয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া যথেষ্ট সময়সাধ্য ব্যাপার। কখনও এক মাস থেকে দেড় মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায় গোটা সেনাগাল পেরতে। কারণ এবড়োখেবড়ো মেঠো পথ ভাঙতে হয় তাঁদের। কিছু জায়গায় পাকা রাস্তা থাকলেও, সেখানে পশু নিয়ে চলার অনুমতি নেই। পাশাপাশি দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থাকা বেশ খরচসাপেক্ষ ব্যাপারও বটে। দক্ষিণে গিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ চারণক্ষেত্র পাওয়া যাবে কিনা, নিশ্চয়তা নেই তারও। পথে মৃত্যুর মুখেও ঢলে পড়ছে বহু পশু। সবমিলিয়ে এক কঠিন পরিস্থিতির দোরগোড়ায় তাঁরা। 

কিন্তু বছরের পর বছর ধরে কেন খরার শিকার হচ্ছে সেনেগাল? এক-কথায় উত্তর, বৃষ্টি রেখার পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে ক্রমশ দক্ষিণে সরছে বৃষ্টিরেখা। আর তার জেরেই অনাবৃষ্টির প্রকোপ দেখা দিচ্ছে উত্তর সেনেগাল-জুড়ে। পাশাপাশি গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিও যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে সেখানকার পরিস্থিতিকে। যুদ্ধকালীন পরিবেশের কারণেই সেনেগালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিষিদ্ধ হয়েছে গবাদি পশুর চারণ। তাতে শুধু পশুপালনই ব্যাহত হচ্ছে না, দেখা দিচ্ছে খাদ্য সংকটও। হ্যাঁ, তেমনই জানাচ্ছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পশুপালন এবং পশুচারণের কারণে উর্বরতা বৃদ্ধি পায় জমির। কিন্তু পশুচারণ নিষিদ্ধ করায় ক্রমশ অনুর্বর হয়ে পড়ছে সেখানকার মাটি। ব্যাহত হচ্ছে খাদ্যের উৎপাদন। ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত স্বাভাবিকের থেকে তিন গুণ বেশি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে অনাহারের মাত্রা। সবমিলিয়ে এক চরম পরিস্থিতির শিকার সেনেগালের মানুষরা। তবে রাষ্ট্রের খুব একটা হেলদোল নেই এ-বিষয়ে। পশুপালকদের জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগও নেয়নি সরকার। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? পরিস্থিতি না বদলালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসন্ন। সেই দুর্দিনের কথা ভেবেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন সে-দেশের দরিদ্র মানুষ…

Powered by Froala Editor

Latest News See More