সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র নিয়ে বিশেষ সেমিনার কলকাতায়

“জলাশয় এবং জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্রকে কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, সে ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তুলতেই এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল।”

বলছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সুমিত মণ্ডল। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্র দূষণ, সমুদ্রের জলতল বৃদ্ধি নিয়ে চর্চা চলছে গোটা বিশ্বজুড়ে। কিন্তু তারপরেও সাধারণ মানুষ কতটা ওয়াকিবহাল সামুদ্রিক পরিবেশের বিষয়ে? সচেতনতা গড়ে তুলতে এবার বিশেষ উদ্যোগ নিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-অধ্যাপকরা। গত ৮ জুন সমুদ্র দিবস (World Ocean Day) উপলক্ষে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে (Presidency University) আয়োজিত হল বিশেষ সেমিনার ‘অ্যাকোয়াম্যানিয়া ’২২’। প্রেসিডেন্সি তো বটেই, সম্ভবত কলকাতায় এই ধরনের উদ্যোগ এই প্রথম। 

বিগত কয়েক বছর ধরেই জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যার ল্যাবরেটরির ছাত্র-ছাত্রী এবং রিসার্চ স্কলারদের সংগঠন ‘অ্যাকোয়াফিল’। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ‘অ্যাকোয়াফিল’-এর যৌথ উদ্যোগেই আয়োজিত হয়েছিল এই সেমিনার। বক্তৃতা রাখেন প্রেসিডেন্সির জীববিদ্যার অধ্যাপক সুমিত মণ্ডল ও কৌশিক প্রামাণিক এবং ভূগোলের অধ্যাপক প্রিয়ঙ্ক প্রবীণ পাটেল।

আরও পড়ুন
পরিবেশ সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে সবার শেষে ভারত!

সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলের মৃত্তিকাক্ষয় থেকে শুরু করে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব, বায়ো-ইনভেশন— আলোচনায় উঠে আসে সামুদ্রিক বিপর্যয়ের সামগ্রিক পরিমণ্ডলের ছবি। অধ্যাপক প্রিয়ঙ্ক পাটেলের বক্তৃতায় ধরা পড়েছিল আমফান কিংবা ইয়াস বিধ্বস্ত কাঁথি, দীঘা, সুন্দরবনের ছবি। আসলে এই পরিণতি কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। এর পিছনেও লুকিয়ে রয়েছে সামুদ্রিক পরিবেশের অবক্ষয়। সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল কংক্রিটে মুড়ে ফেলায় বার বার বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে উপকূলে। ঝাউ কিংবা ম্যানগ্রোভ— উপকূলের ‘নেটিভ স্পিসিস’-এর বৃক্ষচ্ছেদনও তার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে ডঃ কৌশিক প্রামাণিক তুলে ধরেছিলেন মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাবগুলি। ডঃ সুমিত মণ্ডল বক্তব্য রাখেন অতি-স্বল্পচর্চিত বিষয় বায়ো-ইনভেশনের ওপর। 

আরও পড়ুন
অলিম্পিকের জন্য বৃক্ষনিধন, রুখলেন প্যারিসের পরিবেশকর্মীরা

এই কথাটির সঙ্গে অধিকাংশ মানুষের পরিচয় না থাকলেও, তার প্রভাব ইতিমধ্যেই অল্পবিস্তর চোখে পড়েছে সকলের। কিছুদিন আগেই ডায়মন্ড হারবারে ধরা পড়েছিল কুমির মাছ বা অ্যালিগেটর গার। আমেরিকার এই নেটিভ প্রাণীটির উপস্থিতি বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে ভারতীয় বাস্তুতন্ত্রকে। এ তো গেল মাছের কথা। যদি এই একই ঘটনা ঘটে অণুজীবের ক্ষেত্রে? হ্যাঁ, সেই আশঙ্কাও রয়েছে সমানভাবে। আর এই বিষয়টিতেই আলোকপাত করেন অধ্যাপক সুমিত মণ্ডল।

আরও পড়ুন
ক্যানসার নিয়েও পরিবেশরক্ষার লড়াই, গোল্ডম্যান পুরস্কার মেক্সিকান তরুণীর

“কার্গো জাহাজ থেকে মাল নামানোর পর, জাহাজের ভারসাম্য রক্ষার জন্য তার বালাস্ট ট্যাঙ্কে জল ভরা হয়। মূলত সমুদ্রের জলই ব্যবহার করা হয় এক্ষেত্রে। তা এক জায়গা থেকে ভরে অন্য জায়গায় গিয়ে খালি করা হয়”, বলছিলেন অধ্যাপক সুমিত মণ্ডল। এই জলের সঙ্গেই স্থানান্তরিত হয় ছত্রাক, শৈবাল-সহ বিভিন্ন স্থানীয় অণুজীব। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে হাজির হওয়ার পর যা বিষিয়ে তুলতে পারে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রকে। শুধু সামুদ্রিক প্রাণীই নয়, বায়ো-ইনভেশনের শিকার হতে পারে মানুষও। এর আগেও একাধিক মহামারীর অন্যতম কারণ ছিল বায়ো-ইনভেশন। আমাদের অসচেতনতায় সেই ঝুঁকিও বাড়ছে ক্রমশ, ইঙ্গিত দিলেন ডঃ মণ্ডল। জানা গেল, ডঃ সুমিত মণ্ডল এবং তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করেছেন বায়ো-ইনভেশন রুখতে। সুন্দরবন অঞ্চলে প্রাপ্ত অণুজীবদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যভাণ্ডার প্রস্তুত করেছেন তাঁরা। ফলে পরবর্তীতে বায়ো-ইনভেশন হলে খুব সহজেই চিহ্নিত করা যাবে এই ঘটনাকে। তার ভিত্তিতেই নেওয়া যাবে সমস্যা প্রতিকারের পদক্ষেপ।

তবে শুধু সমস্যার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করাই নয়। মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে বায়ো-ইনভেশন প্রতিটি সমস্যারই পৃথক পৃথকভাবে সমাধানের খোঁজ চলেছে গত ৮ তারিখের এই সেমিনারে। পড়ুয়াদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য রাখা হয়েছিল ক্যুইজ এবং পোস্টার প্রতিযোগিতাও। “চলতি বছরে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীরা অংশ নিতে পেরেছে। আগামীতে অন্যান্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ও গবেষকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে এই সেমিনারের দরজা”, জানালেন সুমিতবাবু। এভাবেই ছাত্র-গবেষকদের হাত ধরে একটু একটু করে সচেতনতা ছড়িয়ে পড়বে সাধারণের মধ্যে। বদলাবে পরিবেশের হাল। সেই আশার আলোই দেখাচ্ছে প্রেসিডেন্সির এই সেমিনার…

Powered by Froala Editor