বর্তমান বিশ্বের অন্যতম দুই প্রধান শক্তি যুক্তরাষ্ট্র (USA) ও রাশিয়া (Russia)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে দুই শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ক্রমশ বেড়েছে উত্তরোত্তর। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের আগের ইতিহাস খানিকটা অন্যরকমই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েতের ‘মিত্র’-ই তো বটেই, তারও আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রাশিয়ার। যদিও তাতে আখেরে লাভ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বলতে গেলে দেশের সবচেয়ে রত্নগর্ভ অঞ্চলটিকেই যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিয়েছিল রাশিয়া। যে ‘জ্যাকপট’ হাতছাড়া করার অনুতাপ আজও সম্পূর্ণভাবে মোছেনি রাশিয়ার মন থেকে।
হ্যাঁ, কথা হচ্ছে আলাস্কা (Alaska) চুক্তি নিয়েই। যুক্তরাষ্ট্রের এই অঙ্গরাজ্যের সাবেক কর্তা ছিল জার। এমনকি জারের আমলে রুশরাই প্রথম ‘আবিষ্কার’ করে আলাস্কার হিমশীতল প্রান্তর। জারের আমলে রাশিয়ার রাজস্বের একটা বড়ো অংশ আসত আলাস্কা থেকেই। কিন্তু এমন একটি অন্যতম প্রদেশ হঠাৎ করে আমেরিকার হাতে তুলে দিয়েছিল কেন রাশিয়া?
এই উত্তর খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় তিনশো বছর। আঠারো শতকের শুরুর দিক সেটা। জার পিটার দ্য গ্রেটের আমলে প্রথম আলাস্কা উপকূলের হদিশ পায় রুশ সাম্রাজ্য। আলাস্কার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আবহাওয়া বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হওয়ায় ক্রমশ আলাস্কাকে রাষ্ট্রভুক্ত করতে উদ্যোগী হন জার। ১৭৪০-এর দশক সেটা। আলাস্কা হয়ে উঠেছিল প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রাশিয়ার বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। তখনও আবিষ্কৃত হয়নি রেফ্রিজারেটর। ফলে, সমুদ্রপথে বাণিজ্যের সময় পণ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে রাশিয়ার হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল আলাস্কা। চা, চিনা পোশাক, পশম, মশলা এবং আরও বিভিন্ন সামগ্রীর আড়ত ছিল রাশিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বণিকদের সঙ্গে রুশ বণিকরা জোট বেঁধে গড়ে তুলেছিল ‘রাশিয়ান-আমেরিকান কোম্পানি’-ও। যার নেপথ্যে ছিলেন জার প্রথম পল।
এ তো গেল শুধু বাণিজ্যিক সুবিধা। সিন্ধুঘোটকের দাঁত, তিমির তেল এবং শীলের পশম— রাশিয়ার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডের পিছনে দায়ী ছিল মূলত এই তিনটি বহুমূল্যবান প্রাণীজ সম্পদ। যা থেকে উঠে আসত রাশিয়ার রাজকোষের একটা বড়ো অংশ। এই সকল সম্পদেরও উৎস ছিল আলাস্কাই। তবে অত্যাধিক শিকারে প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যায় আলাস্কার সি-অটার বা সমুদ্র শীল। তলানিতে এসে ঠেকে সিন্ধুঘোটকের সংখ্যা। অন্যদিকে পশমের ‘উৎপাদন’ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজস্ব দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে আলাস্কার স্থানীয় ইনুইট জনগণদের কাছে। শুরু হয় বিদ্রোহ। সেটা উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়।
আরও পড়ুন
বিশ্বের বৃহত্তম দেশ, প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশও; কেন ‘অজেয়’ রাশিয়া?
আরও পড়ুন
ছেড়ে গেছে অধিকাংশ মানুষ, মৃত্যুর অপেক্ষায় রাশিয়ার এই শহর
এরই মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে রাশিয়া এবং ব্রিটেনের মধ্যে। ১৮৫৬ সাল। দীর্ঘ তিন বছরের ক্রিমিয়ার যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত হার মানে রাশিয়া। প্রাণ হারায় ৮ লক্ষাধিক রাশিয়ান নাগরিক। সেইসঙ্গে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ছিল বিপুল। অন্যদিকে ততদিনে রাজস্ব আদায় প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে আলাস্কা থেকে। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বহুদূরে অবস্থিত এমন ‘নিষ্ফলা’ রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণ ও সুরক্ষায় বিনিয়োগ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল রাশিয়ার। আর সেই কারণেই আলাস্কা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়া। কিন্তু কে কিনবে এই বিপুল পরিমাণ জমি?
আরও পড়ুন
এক শতকে ৩ বার নামবদল, রাশিয়ার পিটার্সবার্গকে নিয়ে কমতি নেই বিতর্কের
প্রাথমিকভাবেই উঠে আসে আলাস্কার প্রতিবেশী রাষ্ট্র কানাডার কথা। কিন্তু কানাডা তখনও পর্যন্ত ব্রিটেনের উপনিবেশ। অন্যদিকে আলাস্কা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হলেও ব্রিটিশদের অন্যতম প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র। ১৮১৪-র যুদ্ধের স্মৃতি তখনও মুছে ফেলতে পারেনি মার্কিনিরা। কাজেই ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শেষ হওয়ার বছর কয়েকের মধ্যেই আলাস্কা ক্রয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হয় রাশিয়া। অবশ্য তখন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে সময় লাগে আরও এক দশক।
১৮৬৭ সালে মাত্র ৭২ লক্ষ মার্কিন ডলারে রাশিয়ার থেকে আলাস্কা কিনে নেয় আমেরিকা। কিন্তু প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশ কানাডাকে দু’দিক থেকে সামরিক চাপে রাখতেই এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডটি কিনেছিল আমেরিকা। তাতে যে কোনো বাণিজ্যিক লাভের সম্ভাবনা ছিল, এমনটা একেবারেই নয়। এমনকি আলাস্কা ক্রয়ের পরেও ভূখণ্ডটিতে সেইভাবে বিনিয়োগ করেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তৈরি করেনি কোনো পরিকাঠামোও।
তবে পরিস্থিতি বদলে যায় তিন দশক পরে। আলাস্কায় আবিষ্কৃত হয় প্রকাণ্ড একটি স্বর্ণখনি। তারপরই ক্রমশ আলাস্কায় ভিড় জমাতে থাকে মার্কিন পুঁজিপতিরা। সেইসঙ্গে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে একাধিক স্বর্ণখনি এবং খনিজ তেলের ভাণ্ডার কথা প্রকাশ্যে আসে আলাস্কায়। বলতে গেলে ‘নিষ্ফলা’ আলাস্কাই যেন জ্যাকপট হয়ে ওঠে আমেরিকার কাছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে একাধিকবার আলাস্কা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাশিয়া। আলাস্কায় আমেরিকার শক্তিবৃদ্ধির সমালোচনা করেছেন স্বয়ং পুতিন। সেইসঙ্গে মিশে ছিল আফসোস-ও। তবে বলার অপেক্ষা থাকে না, আজ আলাস্কা রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মানচিত্রের ছবি ও কূটনৈতিক পরিস্থিতিটার চেহারা হত সম্পূর্ণ ভিন্ন…
Powered by Froala Editor