নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার বিধাতা দেননি, অন্তত সামাজিক ব্যবস্থার নিরিখে এমনটাই বলেছিলেন কবি। কিন্তু সমাজের সেই বিধান মাথা নিচু করে মেনে নিতে কোনোদিনই প্রস্তুত ছিল না মেয়েরা। তাই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বুকেও আমরা বারবার সাক্ষী থেকেছি মেয়েদের প্রতিবাদের। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁরা এগিয়ে এসেছেন। তবে সেখানেও নাকি কিছু কাজ পুরুষের, আর কিছু কাজ নারীর। না, কমান্ডো ট্রেনার সীমা রাও এই বিভাজন মানেন না। মানেন না বলেই আজ তিনি তাঁর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন।
সীমা রাও দেশের প্রথম মহিলা কমব্যাট ট্রেনার। শুধু প্রথম নন, এখনও অবধি তিনিই একমাত্র। আর এমন একটা কীর্তির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই জড়িয়ে আছে তাঁর বিচিত্র জীবন। স্বাধীনতা সংগ্রামী রমাকান্ত সিনারির পরিবারে তাঁর জন্ম। ছোটো থেকেই শুনতেন দেশ স্বাধীন করার জন্য তাঁর বাবা এবং অন্যান্য সহকর্মীদের আত্মত্যাগের কথা। সেই থেকেই নিজের মধ্যে একটা জেদ তৈরি হয়েছিল তাঁর। তিনিও এই দেশের জন্য কিছু করবেন, লাজুক শান্ত স্বভাবের সীমার মনে এই কথাটাই জোরের সঙ্গে প্রতিধ্বনিত হত।
কর্মসূত্রে প্রথমে যদিও তিনি বেছে নিয়েছিলেন ডাক্তারি পেশাকে। পাশাপাশি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের উপর এমবিএ কোর্স করেছেন তিনি। কিন্তু ধরা বাঁধা ছকের নিয়মটা বেশিদিন টিকল না। সীমার জীবনে পরিবর্তন নিয়ে এলেন দীপক রাও নামের এক যুবক। এই দীপকের সঙ্গেই পরে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন তিনি। দীপক মার্শাল আর্টে দক্ষ। তাঁর কাছেই প্রথমে ট্রেনিং নিয়েছিলেন সীমা। এরপর বক্সিং, ক্যারাটে, তাইকন্ডু প্রভৃতি নানারকম শারীরিক কৌশলের খেলা রপ্ত করেছেন। স্নাতক স্তরে পড়ার সময়েই তাইকন্ডু খেলায় ব্ল্যাক বেল্ট অর্জন করেছেন তিনি।
এরপর সীমা আর দীপকের জীবন চলেছে একই খাতে। দুজনেই যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। গত ২০ বছর ধরে জওয়ানদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন দুজনেই। সীমার হাতে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন অন্তত ২০ হাজার জওয়ান। সেনাবাহিনী বলতেই যাঁদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরুষের ছবি, সীমা রাও তাঁদের সামনে এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ। ভারতীয় বায়ু সেনা, আর্মি মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট সহ সেনাবাহিনীর নানা বিভাগের ট্রেনিং সফলভাবে সম্পন্ন করে চলেছেন তিনি। আজ পঞ্চাশ বছর বয়সে এসেও তাঁর কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা মুগ্ধ করে।
শুধুই সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষক নন, তাঁকে আমরা পেয়েছি চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও। ভারতের প্রথম মিক্সড মার্শাল আর্ট সিনেমা 'হাতাপায়ি' তাঁরই নির্দেশনায় তৈরি। তাছাড়া ব্রুস লির কাছ থেকে 'জিত কুনে দো' প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশ্বের ১০ জন মহিলার একজন সীমা।
সেনাবাহিনী নিয়েই পরিবার রাও দম্পতির। দুজনে একসঙ্গে আবিষ্কার করেছেন একটি নতুন রিফ্লেক্স ফায়ার পদ্ধতি। আর তাঁর কাজের জন্য পেয়েছেন আর্মি চিফ সাইটেশনস পুরস্কার, ওয়ার্ল্ড পিস ডিপ্লোম্যাট পুরস্কার। এছাড়া ২০১৯ সালে ফোর্বস 'ডব্লিউ-পাওয়ার ট্রেলব্লেজার' পুরস্কার এবং নারীশক্তি সম্মান পেয়েছেন তিনি। স্ত্রীর এই সম্মানে খুশি দীপক রাও নিজেও। তাঁর কথায়, আজ একুশ শতকেও যখন পুরুষের কর্তৃত্বেই পরিচালিত সমস্ত সমাজ তখন সীমার মতো মহিলারাই দৃষ্টান্ত। এই সমাজে সত্যিই এক ওয়ান্ডার ওম্যান তিনি।
আরও পড়ুন
অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াই এভারেস্ট জয়, বিরল কৃতিত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেলের
Powered by Froala Editor