টরেটক্কা— এই শব্দটির সঙ্গে বর্তমান প্রজন্ম খুব একটা পরিচিত নয়। কিন্তু শব্দটির সঙ্গে যে যন্ত্রটি সম্পর্কিত, সেটি একটা সময় গোটা ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্য পথ খুলে দিয়েছিল। ব্যাপারটি আর কিছুই নয়, টেলিগ্রাফ। এখন অবলুপ্ত হয়ে গেলেও, একটা সময় এটাই ছিল দ্রুত যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। কত ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই নামটির সঙ্গে। আর সেই ইতিহাসের অন্যতম প্রধান অংশ ছিলেন একজন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার, বলা ভালো ‘প্রথম’ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি শিবচন্দ্র নন্দী, ভারতে টেলিগ্রাফ প্রবর্তকদের মধ্যে অন্যতম।
সময়টা উনবিংশ শতকের গোড়ার দিক। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিশেষ সংকেত বা সংবাদ পাঠানোর জন্য সেরকম উন্নত কিছু ছিল না। থাকার মধ্যে ছিল ‘সেমাফোর’ যন্ত্র। কলকাতার রাস্তায় কিছুদূর অন্তর যে উঁচু স্তম্ভগুলি দেখা যায়, তার মাথায় থাকত এই সেমাফোর। যে সংকেতটা দেখানো হত, পরবর্তী স্তম্ভ থেকে দূরবীনের সাহায্যে সেটিকে দেখতে হত। এইভাবে পুরো ব্যবস্থাটা চলত চেন সিস্টেমের মতো। এতে সময়ও লাগত অনেক বেশি। খবর যাতে জায়গামতো তাড়াতাড়ি পৌঁছোয়, সেজন্য একটা বিকল্প উপায়ের খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
সেই সময় কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজে প্রথম রসায়ন ও মেটিরিয়া মেডিকার অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন উইলিয়াম ও’শনেসি। ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসে অন্যতম কিংবদন্তি নাম। বলা যেতে পারে, ও’শনেসিই ভারতে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার জনক। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন তিনি। ১৮৫১ সাল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে অনুমতি আদায়ের পর তিনি শুরু করলেন টেলিগ্রাফ বসানোর কাজ। ততদিনে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে এক বাঙালি যুবকের। শিবচন্দ্র নন্দী। কলকাতা টাঁকশালে কাজের সূত্রে আলাপ পরিচয়। তখনই শিবচন্দ্রের কারিগরি দক্ষতায় মুগ্ধ হন ও’শনেসি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শিবচন্দ্র তাঁর কাছের লোক হয়ে উঠলেন। টেলিগ্রাফ বসানোর মতো কাজে তাই শিবচন্দ্রকেই অ্যাসিসটেন্ট করলেন তিনি।
এর পরের কাহিনি ইতিহাস সৃষ্টির। সেখানে শিবচন্দ্র নন্দীর অবদান অবিস্মরণীয়। প্রাথমিক পর্যায়ে কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন বসানো হয়েছিল। ’৫১ সালে শিবচন্দ্রই ডায়মন্ড হারবার থেকে প্রথম বার্তাটি প্রেরণ করেন কলকাতায়। অন্য প্রান্তে তখন ও’শনেসির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং লর্ড ডালহৌসি। শুরু হল এক যাত্রার। যার কারিগরির মশাল বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন শিবচন্দ্র নন্দী। পরবর্তীকালে দেশের নানা প্রান্তে টেলিগ্রাফ লাইন পাতার কাজ তদারকি করেছিলেন তিনি। প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও তাঁর বাস্তব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জ্ঞান আজও শিক্ষণীয়। সেই সময় ইলেকট্রিকের তার খাটানোর লোহার খুঁটি সুদূর ইংল্যান্ড থেকে আনা হত। তাতে টাকা ও সময়— দুটোই ব্যয় হত অনেক। এই সমস্যার চমকপ্রদ উপায় বের করলেন শিবচন্দ্র। তালগাছের লম্বা লম্বা গুঁড়িকে এই খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করলেন তিনি। তবে তাঁর সবচেয়ে রোমাঞ্চকর কাজটি ছিল কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন বসানো। কারণ সেই তার মাটির ওপর নয়, পদ্মার নিচে ‘সাবমেরিন কেবল’ হিসেবে বসাতে হবে তাঁকে। আর সেই সময়ের পদ্মার কী ভীষণ রূপ ছিল, তার বর্ণনা অনেক উপন্যাস গল্পেই পড়েছি আমরা। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই অসাধ্যসাধন করেছিলেন তিনি। বেঁচে গিয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের দশ হাজার টাকা।
একটা সময় এশিয়াটিক সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করা এই বাঙালি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের শেষ জীবন অতিবাহিত হয়েছিল কষ্টকরভাবে। সেই সময় প্লেগ রোগটি প্রায় মহামারির আকার নিয়েছিল। সেই মহামারির কোপেই ১৯০৩ সালে মারা যান শিবচন্দ্র নন্দী। যেদিন মারা যান, সেদিন শহরের টেলিগ্রাফ অফিস বন্ধ ছিল। বন্ধ ছিল টরেটক্কার আওয়াজ। সেই আওয়াজ, আজ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তার থেকেও দ্রুত মাধ্যম চলে এসেছে আমাদের হাতে। আর আমরাও ভুলে গেছি শিবচন্দ্র নন্দীর কথা। ভুলে গেছি তাঁর পদ্মা জয়ের কাহিনি। কলকাতার বউবাজার অঞ্চলের ‘শিবু নন্দীর লেন’ এখনও তাঁর নাম বয়ে চলেছে। মিউজিয়ামগুলোতে সংরক্ষিত আছে সেই সময়ের ইতিহাস। তার বাইরে, বিস্মৃতির অন্ধকারে ঢুকে গেছে ভারতে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার অন্যতম পথিকৃতের নাম।
Powered by Froala Editor