১৯৪১ সাল। ভয়াবহ রূপ নিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নাৎসি জার্মানির বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন নরওয়ে। দেশের প্রাচীন সম্পদগুলি ধ্বংসের মুখোমুখি। অবিলম্বে পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু না করলে চিরতরে মুছে যাবে প্রাচীন গির্জাগুলির গায়ে আঁকা শিল্পকর্ম। সরকারের পক্ষে এখন রক্ষণারেক্ষণ সম্ভব নয়। তাহলে উপায়? নরওয়ের বিখ্যাত কিউরেটার গেরহার্ড গোটাস (Gerhard Gottas) দায়িত্ব তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। বেশ কয়েকটি গির্জা পুনরুদ্ধারের কাজ করে অবশেষে পৌঁছলেন সউহেরাদ গ্রামে। প্রায় ৯০০ বছর পুরনো একটি চার্চ আছে সেখানে।
বেশ কয়েকদিন দরজা বন্ধ করে সেখানে কাজ করলেন গোটাস। দরজা খুলতেই দেখা গেল এক ভয়ানক দৃশ্য। চার্চের একটি দেওয়াল জুড়ে খোদাই করা আছে ছোটো ছোটো অসংখ্য দৈত্যের মুখ। এক আদিম রহস্য খেলা করছে তাদের মুখে। ছোটো চোখগুলিতে লেখা রয়েছে পৈশাচিক তৃপ্তি। মানুষকে পাপের পথে টেনে এনে শান্তি পাবে তাদের হিংস্র আত্মা। মুহূর্তের মধ্যে হইচই পড়ে যায় ‘ডেমন ওয়াল’ (Demon Wall) নিয়ে। যুদ্ধক্লান্ত দেশবাসীর মনে বাসা বাঁধে কোনো অশনি সংকেত। চার্চের ভগবানের বদলে আরাধ্য হয়ে ওঠে ‘শয়তান’। আজও নরওয়ের সেই চার্চে গেলে দেখা যায় সেই ভয়ঙ্কর ছবিগুলি।
গোটাস দাবি করেছিলেন, দেওয়ালের গায়ে তিনি এই অদ্ভুত শিল্পকর্মগুলি আবিষ্কার করেন। আরও স্পষ্ট করে বললে, দেওয়ালে বহু পুরনো ছবিগুলির দাগ দেখে সেগুলিকে ভরাট করেন তিনি। মনে করা হতে থাকে, অন্তত পাঁচশো বছর প্রাচীন এই ছবিগুলি। ইতিহাসবিদদেরও আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে ওঠে ছোট্ট শান্ত গ্রামটি। কিন্তু সম্প্রতি জানা গেল অন্য গল্প। ছবিগুলির বয়স মাত্র ৮০। এবং স্রষ্টা আর কেউ নন, গেটাস স্বয়ং।
নরওয়ের একটি গবেষণা সংস্থা ‘নিকু’-র দুই কিউরেটর এলিজাবেথ অ্যান্ডারসন ও সুসেন কউন ‘ডেমন ওয়াল’ পরীক্ষা করতে গিয়ে খানিক আশ্চর্য হন। সমগ্র চার্চটি আঠারো শতকের নিদর্শনে পরিপূর্ণ। মধ্যযুগীয় কোনো শিল্পের নমুনা এখানে নেই। তাহলে শুধুমাত্র এই দেওয়ালের ছবি এত প্রাচীন হয় কীভাবে? তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেন ছবিগুলির তলায় কোনো আঁচড়ের দাগই নেই। আর যেটুকু দাগ আছে, গোটাস সেগুলি ছুঁয়েও দেখেনি। অর্থাৎ দেওয়াল জোড়া শিল্পকর্মের পুরোটাই গোটাসের কীর্তি।
আরও পড়ুন
দৈর্ঘ্য ৫০ ফুট! সত্যিই কি কঙ্গোয় লুকিয়ে এমন দৈত্যাকার সাপ?
মজার বিষয়, গেরহার্ড গোটাস কোনো অচেনা কিউরেটার নন। একাধিক ঐতিহাসিক স্থানে তিনি কাজ করেছেন, অতীতের বহু ঐতিহ্যকে নতুন করে নিয়ে এসেছেন জনসমক্ষে। কিন্তু সউহেরাদে ঘটে একটি ব্যতিক্রম। অন্যত্র কাজ করতেন সর্বসমক্ষে। একমাত্র এখানেই ছিলেন বন্ধ দরজার আড়ালে।
আরও পড়ুন
দুর্গের নিচে ৩ মিটারের নরকঙ্কাল, বাস্তবেই অস্তিত্ব ছিল দৈত্যাকার মানুষদের?
হঠাৎ এখানে এসেই মতিভ্রম হল কেন তাঁর? নাকি সত্যিই ভর করেছিল শয়তান। এলিজাবেথ-রা গোটাসের অতীত জীবন থেকে তুলে এনেছেন সম্ভাব্য তত্ত্ব। গোটাস হতে চেয়েছিলেন চিত্রকর। ছবি পাঠিয়েছিলেন বেশ কিছু প্রদর্শনীতেও। কিন্তু প্রতিষ্ঠা পাননি। অবশেষে হয়ে গেলেন কিউরেটর। ইতিহাসের ক্ষেত্রেও মূলত আকর্ষণ ছিল মধ্যযুগের শিল্পকর্মে। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে আঠারো শতকের পুরনো কিছু পাননি।
তাই সউহেরাদে এসে তৈরি করলেন আশ্চর্য পরিকল্পনা। রেখে গেলেন এমন এক শিল্পকর্ম, যা দীর্ঘ ৮০ বছর ধরে বোকা বানিয়ে এসেছে নরওয়ের ইতিহাসবিদদের। যেমন ধরা যাক সবচেয়ে ভয়ানক ছবি ‘বেলজেবাব’-এর কথা। যার আক্ষরিক অর্থই ‘শয়তান’। বাইবেলের মতো করে গোটাস তাঁর বিরাট মুখে এঁকেছেন দীর্ঘ দাড়ি। বাকি সব কটি ছবির থেকে আকারেও বড়ো এটি।
নরওয়ের গ্রামে ৮০ বছর ধরে গির্জায় ঝুলে আছে ‘শয়তান’-রা। তৈরি হয়েছে অসংখ্য গল্প। ছোট শিশুদের শাসন করেছে তারা। মানুষের পাপ-পুণ্যের হিসেবে ভরে গেছে ঝুলি। এলিজাবেথদের মতে, আসল শয়তানের কাজ করেছেন গোটাস নিজে। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জীবিত থাকলে নিশ্চয়ই প্রশ্নের মুখে পড়তে হত গোটাসকে। তিনি দেশের স্থাপত্যকে বিকৃত করেছেন, তার নিচে লুকিয়ে থাকা অন্য ছবি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও নষ্ট করেছেন।
একই সঙ্গে গোটাসের শিল্পকর্মের প্রশংসা করতেও ভুলছেন না তাঁরা। পুরনো দেওয়ালের গায়ে এরকম বিস্তারিত ছবি ফুটিয়ে তোলা রীতিমতো পাকা হাতের কাজ। তারিফ করছেন তাঁর ধুরন্ধর বুদ্ধিরও। অন্যান্য ঐতিহ্যগুলি পুনরুদ্ধারে হয়তো বিখ্যাত হতেন না তিনি, কিন্তু শয়তানের দৌলতে নরওয়ের দেওয়ালে অমর হয়ে রইল গেটাসের নাম।
Powered by Froala Editor