বাড়ির পিছনের জঙ্গলে রয়েছে প্রিয়জনের সমাধি। তার ওপরে নামানো কয়েক টুকরো পাথর। সবার চোখ এড়িয়ে প্রিয়জনের স্মৃতির উদ্দেশে প্রার্থনা জানাতে এসেছেন এক মানুষ। প্রথমে টুকরো পাথরগুলিকে ‘ক্রস’ চিহ্নের আকারে সাজালেন। তারপর সন্তর্পনে প্রার্থনা সেরেই আবার এলোমেলো করে দিলেন। যাওয়ার আগে আরেকবার দেখে নিলেন চারদিক। কেউ দেখে ফেলেনি তো? জাপানে আজও দেখা যায় এমন দৃশ্য। গোপন এই খ্রিস্টান সমাজের নাম ‘কাকুরে কিরিসিথান’ (Kakure Kirisithan) বা গুপ্ত খ্রিস্টান। না, আজকের জাপানে নিজের মতো ধর্মাচরণ অপরাধ নয়। কিন্তু একসময় খ্রিস্টধর্ম পালনের অপরাধে জাপানে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থাও ছিল। আর সেই সময় থেকেই শুরু হয় এই গোপন ধর্মাচরণ।
১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে জাপানে খ্রিস্টান ধর্ম নিষিদ্ধ হয়। সিন্টো ও বৌদ্ধ ছাড়া অন্য যে কোনো ধর্ম পালনই নিষিদ্ধ করা হয়। অবশ্য এর পিছনে ছিল মূলত রাজনৈতিক কারণ। সপ্তদশ শতকে সারা এশিয়াজুড়ে নানা ইউরোপীয় শক্তি উপনিবেশ বিস্তারের চেষ্টা করছিল। আর তাঁদের মূল সৈনিক ছিলেন খ্রিস্টান মিশনারিরা। মিশনারিদের আটকাতেই খ্রিস্ট ধর্মের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবে ১৬৩০ সালে আরেকটি আইনে বলা হয়, জাপানের সমস্ত মানুষকে কোনো না কোনো মন্দিরের সদস্যপদ গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ বৌদ্ধ বা সিন্টো ধর্ম মেনে নিতে হবে।
এই সময়েই নাগাসাকি অঞ্চলে প্রথম গড়ে ওঠে গোপন খ্রিস্টান সম্প্রদায়। তাঁরা নিজেরা না বাঁচলে বাঁচবে না তাঁদের ধর্মবিশ্বাসও। আর তাই শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্যে কেউ বৌদ্ধ বা কেউ সিন্টো ধর্মকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের বাড়িতে গোপন ঘরে ক্যাথলিক রীতি মেনে ঈশ্বরের আরাধনা করতেন। যদিও সময়ের নিয়মে দুই পৃথক ধর্মমত অনেকখানি মিলেমিশেও গিয়েছে। মিলেমিশে গিয়েছে নানা মূর্তির চেহারাও। যেমন মাতা মেরির রূপ হয়ে উঠেছে বৌদ্ধ দেবী কাননের মতো। তাঁর নামই হয়ে উঠেছে ‘মারিয়া কানন’। অবশ্য এর পিছনেও অন্য এক কারণ ছিল। প্রকাশ্যে ঘরের মধ্যে মেরির ছবি তো টাঙিয়ে রাখা যাবে না। তাই এমন ব্যবস্থা।
বাইবেলের প্রতিটা অধ্যায় অনুবাদ করেছিলেন কাকুরে কিরিসিথান ধর্মাবলম্বীরা। অনুবাদের সময় প্রতিটা পঙক্তিকে বৌদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণের মতো ছন্দোবদ্ধ করে তুলেছিলেন। যাতে হঠাৎ এক ঝলক শুনেই কেউ বুঝতে না পারেন যে বাইবেল পাঠ করা হচ্ছে। এভাবে প্রায় আড়াই শতক ধরে জাপানের বুকে খ্রিস্টান ধর্মের প্রবাহকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তাঁরা। অবশেষে এল সেইদিন। ১৮৭৩ সালে মেইজি সংস্কারের মাধ্যমে জাপানকে ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষণা করা হয়। খ্রিস্ট ধর্ম পালনেও আর কোনো বাধা রইল না। একে একে অনেক মানুষই ক্যাথলিক চার্চে যুক্ত হলেন। কিন্তু অনেকেই একইভাবে গোপনে খ্রিস্ট ধর্মের চর্চা করে গেলেন। এটাই যে তাঁদের পারিবারিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে ততদিনে।
আরও পড়ুন
আকবরের অনুগ্রহে তৈরি গির্জা, খ্রিস্ট ধর্ম নিয়েছিলেন তাঁর বংশধররাই
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাকুরে কিরিসিথানদের সংখ্যা কমেছে। অনেকেই মনে করেছেন এভাবে গোপন ধর্মাচরণের আর প্রয়োজন নেই। তাঁরা এক এক করে ক্যাথলিক চার্চে যোগ দিয়েছেন। আবার যে নাগাসাকিকে ঘিরে এই ধর্ম গড়ে উঠেছিল, ১৯৪৫ সালে সেই শহরটাই ধ্বংস হয়ে যায় পরমাণু বোমার আঘাতে। তবে এখনও বেশ কয়েকটি পরিবার এই সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন। কাকুরে কিরিসিথানকে পৃথক ধর্মমত হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাপান সরকারও। একদিকে বৌদ্ধের মতো পেগান ধর্ম, অন্যদিকে আব্রাহামিক খ্রিস্টান ধর্ম – এই দুয়ের মধ্যে যেন আলগা সেতুর মতো রয়ে গিয়েছেন কাকুরে কিরিসিথানরা।
তথ্যসূত্রঃ The secret world of Japan's 'Hidden Christians', BBC
আরও পড়ুন
জাপানে ক্যাফে খুললেন রাসবিহারী বসু, বাঙালি খাবারের স্বাদে মাতোয়ারা সে-দেশের মানুষ
Driven Underground Years Ago, Japan's 'Hidden Christians' Maintain Faith, Anthony Kuhn, NPR
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মৃত্যুর ৪৬৭ বছর পরেও দেহ প্রায় অবিকৃত, গোয়ায় শায়িত এই ‘অলৌকিক’ খ্রিস্টান সাধু