“যদি একজন সুইৎজ ব্যাঙ্কারকে বিশ্বাস করতে না পারো, তাহলে আর কাকে করবে?” ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট এনাফ’ সিনেমায় এমনই বলেছিলেন জেমস বন্ড। সুইৎজ ব্যাঙ্ক (Swiss Bank) ততদিনে অর্থনৈতিক রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। আর সেই বিতর্ককেই আবার উস্কে দিয়েছে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি রিপোর্ট। এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যাঙ্ক কর্মচারী প্রায় ৩০ হাজার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন। আর তাতে জমা থাকা মোট সম্পদের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান বা লে-মন্ডের মতো প্রথম সারির আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার দৌলতে সেই খবর ইতিমধ্যে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে।
সুইৎজ ব্যাঙ্ক বরাবরই বেশ আলোচিত একটি বিষয়। অন্তত ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে তো বটেই। প্রায় সমস্ত সংসদীয় নির্বাচনের আগেই শোনা যায় সুইৎজ ব্যাঙ্কের টাকা ফিরিয়ে আনার কথা। এর মধ্যে ভারত ও সুইৎজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে সমঝোতাও হয়েছে ২০১৯ সালে। কিন্তু তাতেও বিষয়টা খুব একটা বদলায়নি। কারণ সুইৎজ ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত তথ্য সুইৎজারল্যান্ড সরকারের কাছেও নেই। ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, ঠিক কী কারণে এই গোপনীয়তা? আর এই গোপনীয়তার শুরুই বা কী কারণে?
সুইৎজ ব্যাঙ্ক একটি কোনো ব্যাঙ্ক নয়। আসলে সুইৎজারল্যান্ডের প্রতিটা ব্যাঙ্ককে একসঙ্গে সুইৎজ ব্যাঙ্ক বলা হয়। আর প্রতিটা ব্যাঙ্কেই গোপনীয়তার শর্ত একইরকম। কোনো গ্রাহকের তথ্যই তাঁরা কাউকে দেন না। এমনকি দেশের সরকারকেও না। একমাত্র কোনো গ্রাহকের নামে আইনানুগ মামলা শুরু হলে আদালতের নির্দেশে তাঁরা তথ্য জানাতে পারেন। তবে তারও কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। কিন্তু কেন এই গোপনীয়তা? সেটা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে অষ্টাদশ শতকে।
তখনও ইউরোপে শিল্প বিপ্লব হয়নি। ফরাসি বিপ্লবও হয়নি। তবে প্রাচীন ধর্মকেন্দ্রিক রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ জমতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ফ্রান্সের অভিজাতরা, যাঁরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা একটা বিদ্রোহের পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছিলেন। আর এর মধ্যেই রাজপরিবারের কিছু সদস্যও গোপনে ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিলেন। আর কে না জানে, ক্ষমতা বিস্তারের প্রধান মাধ্যম হল অর্থ।
অর্থ সঞ্চয় করতে হবে, কিন্তু তা একেবারে গোপনে। এটাই ছিল ফ্রান্সের অভিজাতদের উদ্দেশ্য। আর জেনেভা শহর হয়ে উঠেছিল তাঁদের সমস্ত গোপন আলাপ আলোচনার কেন্দ্র। সেই সময় থেকেই জেনেভা শহরে একাধিক ব্যাঙ্ক তৈরি হয়। প্রতিটা ব্যাঙ্কই ছিল গোপন। পোপ তো বটেই, রাজারাও যেন এইসব ব্যাঙ্কের অস্তিত্বের হদিশ না পান। আর তাই মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তৈরি হয়েছিল ভল্ট।
জেনেভা শহরে প্রথম গোপন ব্যাঙ্ক তৈরি হয় সম্ভবত ১৭১৩ সালে। এরপর ৯০ বছরের মাথায় শিল্পবিপ্লব এবং ফরাসি বিপ্লব দুইই ঘটে যায়। অভিজাতদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যও গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে। এমনকি পোপের কথাকেও অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা পেয়ে যান তাঁরা। কিন্তু জেনেভার ব্যাঙ্কগুলি তাদের নির্দিষ্ট শর্ত বদলাতে রাজি হয় না। দুই শতাব্দী পর আবার দানা বাঁধে বিতর্ক। আর সেই বিতর্কের মধ্যে অবশেষে পাশ হয়ে যায় ১৯৩৪ সালের সুইৎজ ব্যাঙ্কিং অ্যাক্ট। এই আইনে যে শুধু সমস্ত ব্যাঙ্ককে তথ্য গোপন রাখার অধিকার দেওয়া হয় তাই নয়, কোনো ব্যাঙ্ক যদি গ্রাহকের তথ্য গোপন না রাখে তাহলে সেই ব্যাঙ্কের আধিকারিকের অন্তত ৫ বছর জেল হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।
এরপর বহু বিতর্কেও আইন বদলায়নি। অথচ সুইৎজ ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলা খুব কঠিন বিষয় নয়। শুধু পাসপোর্ট থাকলেই পৃথিবীর যে কোনো দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। সুইৎজারল্যান্ড সরকারের হিসাব অনুযায়ী দেশের সমস্ত ব্যাঙ্কে সঞ্চিত মোট সম্পদের ৩৫ শতাংশই বিদেশি। এর মধ্যে সমস্ত অর্থই যে বে-আইনি বা কালো টাকা তা নয়। কিন্তু আয়কর ফাঁকি দিতে এমন সুযোগেরও যে জুরি নেই।
Powered by Froala Editor