কিছুদিন আগেই ভারতের অরুণাচল প্রদেশে পাওয়া গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বেশ কয়েকটি বোমা। আর তা নিয়েই রীতিমতো সাড়া পড়ে গিয়েছিল গোটা ভারতে। তবে পশ্চিমের দেশ জার্মানির দিকে যদি তাকানো যায়, এমন ঘটনা সেখানকার নিত্যদিনের। রাস্তা বা কোনো বাড়ি নির্মাণ, নদীতে মৎস্যশিকার এমনকি কৃষিজমিতে চাষের সময়ও হামেশাই উপস্থিতি জানান দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিস্ফোরকরা। জার্মানির নাগরিকরাও এক প্রকার অভ্যস্থই হয়ে গেছেন এমন ‘ঝুঁকিপূর্ণ আবিষ্কারের’ সঙ্গে।
গত বছরেও কয়েক ডজন বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছিল জার্মানির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তবে ২০১১ সালের রেকর্ড শুনলে শিউরে উঠবে গা। শুধু সেই বছরেই উদ্ধার হয়েছিল ৫৫০০টির বেশি বিশ্বযুদ্ধের গ্রেনেড, শেল এবং এরোপ্লেন থেকে নিক্ষেপিত বিশালায়ন বোমার। যার গড় করলে দাঁড়ায়, প্রতিদিন উদ্ধার করা হয়েছিল ১৫টি করে বোমা।
ইতিহাস বলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৪০ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে জার্মানিতে ব্রিটিশ এবং মার্কিন বাহিনী নিক্ষেপ করেছিল সব মিলিয়ে সাড়ে ১৩ লক্ষ টন বিস্ফোরক। যার মধ্যে ১৯৪৪ ও ১৯৪৫ সালেই নিক্ষেপিত হয়েছিল সাড়ে ৬ লক্ষ টন বোমা। নাৎসিদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য ব্রিটিশ এবং মার্কিন বাহিনীর মূল লক্ষ্যই ছিল জার্মানির বড় শহর, বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং শিল্পাঞ্চলগুলি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বার্লিন, হামবুর্গ, রুঢ়, কোলন, ওয়েলেস প্রভৃতি শহর।
বিশ্বযুদ্ধে বোমা বিস্ফোরণে জার্মানির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ঠিকই, তবে বিস্ফোরণ হয়নি নিক্ষেপিত সমস্ত বোমার। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এবং প্রিমিটিভ প্রযুক্তিতে তৈরি হওয়ার দরুন অনেকক্ষেত্রেই সঠিকভাবে ট্রিগার্ড হত না অভ্যন্তরীণ স্ফুলিঙ্গ। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই সেসব চাপা পড়ে গিয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের সময়।
তবে সময় নিজের মতো এগিয়েছে। ধ্বংসস্তূপের ওপরেই নতুন করে গড়ে উঠছে সভ্যতা, নগরী। শুধু তাদের তলায় রয়ে গেছে প্রাণঘাতী বিস্ফোরকরা। আজও তারা মাঝে মাঝেই জানান দেয় উপস্থিতি। দ্রুত উদ্ধারকার্যে নামে বিশেষজ্ঞ দল। ঘটনাস্থলকে কেন্দ্র করে প্রায় দেড় কিলোমিটার ব্যাসের অঞ্চল থেকে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অন্যত্র। তারপর নিষ্ক্রিয় করা হয় বিস্ফোরকগুলিকে।
তবে এই প্রক্রিয়া যে একেবারে নিরাপদ তেমনটা নয়। প্রায় সাত দশক আগের নিক্ষেপিত বোমাগুলির ধাতব আস্তরণে মরচে পড়ে গেলেও, এখনও সতেজ রয়েছে ভেতরের বারুদ। কাজেই মাঝেমধ্যে ঘটে যায় বড়োসড়ো দুর্ঘটনাও। ১৯৯৪ সালে এমনই একটি বোমার নিষ্কাষণের সময় বিস্ফোরণ ধ্বংস করে দিয়েছিল বেশ কয়েকটি সরকারি ভবন। ২০১২ সালে ২৫০ কেজি এবং ২০১৩ সালে ১০ হাজার কেজি’র দুটি বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল মিউনিখ শহরের একাংশ। মারা গিয়েছিল ডিসপোসাল ইউনিটের কর্মীরাও।
আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের অদ্ভুত ঘটনা; একটি সামান্য ‘টয়লেট’ ধরিয়ে দিল জার্মান সাবমেরিনকে!
কিন্তু কতদিন এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যেতে হবে জার্মানদের, জানা নেই কারোর। কত সংখ্যক বোমা এখনও লুকিয়ে রয়েছে জার্মানির গর্ভে, তারও হিসেব নেই। তবে আনুমান করা হয় তার সংখ্যা এক লক্ষেরও বেশি। অবশ্য তাদেরকে একদিনে খুঁজে বার করা সম্ভব নয়। সে জন্যই জার্মানিতে সবসময়ই প্রস্তুত থাকেন বোমা নিষ্ক্রিয়কারী কর্মীরা। প্রস্তুত থাকে দমকল বাহিনীও। কারণ, আকস্মিকভাবেই তাঁদের কাছে ভেসে আসে অতীতের অশনি সংকেত...
Powered by Froala Editor