পৃথিবীজুড়ে জলবায়ুর অবনতি সম্পর্কে নতুন করে আর কিছু বলার নেই। গত কয়েকমাসে পরপর কয়েকটি ঘটনায় বারবারই শিরোনামে উঠে এসেছে পরিবেশ ও জলবায়ুর সংকটের কথা। তা আমাজনের দাবানলই হোক, বা আলাস্কার হিমবাহের গলে যাওয়া। এর বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে আন্দোলনেরও কমতি নেই। ১৬ বছরের কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ ইতিমধ্যেই এই আন্দোলনের একজন পরিচিত মুখ। গত ২০-২৭ সেপ্টেম্বর গ্রেটা ডাক দিয়েছিলেন বিশ্বব্যাপী জলবায়ু ধর্মঘট বা গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইকের। গ্রেটার ডাকে সাড়া দিয়ে সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য পরিবেশকর্মী অংশগ্রহণ করেছিলেন এই ধর্মঘটে। সারা বিশ্বের প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ নেমেছিলেন পথে। বাদ যায়নি বাংলাও।
আগামীকাল অর্থাৎ ২৯ নভেম্বর দ্বিতীয়বারের জন্য বিশ্বব্যাপী জলবায়ু ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। গোটা পৃথিবীজুড়ে মানুষজন আবার পথে নামবেন জলবায়ু রক্ষার দাবিতে। শামিল হবেন বাংলার আন্দোলনকারীরাও। কলকাতা, নৈহাটি, দুর্গাপুর, বর্ধমান, নালিকুল প্রভৃতি জায়গায় আগামীকাল বিভিন্ন সভাসমিতি ও মিছিল ইত্যাদির আয়োজন করা হয়েছে এই উপলক্ষে।
গ্রেটার হাত ধরে এই ধর্মঘট-আন্দোলন শুরু হলেও, আজ তা আর গ্রেটা-কেন্দ্রিক নেই, একটি সার্থক গণআন্দোলনের রূপ নিয়েছে বলা যায়। ইউরোপ আমেরিকার মত তথাকথিত উন্নত বিশ্বের মানুষ যেমন কথা বলছেন এ নিয়ে, তেমনই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মানুষও পথে নামছেন।
ধরা যাক বাংলার কথাই। ঝাড়গ্রাম শহরের মানুষ উন্নয়ন ও সৌন্দর্যায়নের নামে নির্বিচারে শহরের শালবনানী ধ্বংসের বিরুদ্ধে, ঘাসে ভরা খেলার মাঠ ধুলিসাৎ করে রাজ্যসরকারি মেলা-মোচ্ছবের বিরুদ্ধে জোট বাঁধছেন। তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই থেকে দূষণের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ হয়েছে একাধিকবার। নালিকুলে স্থানীয় মানুষ ওয়াক্স সেটিং কারখানার দূষণে ও কারখানামালিকের হুমকিতে কোণঠাসা হতে হতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে নদী-বন-পাহাড়, বনজ মানুষ ও বন্যপ্রাণী ধ্বংসকারী প্রস্তাবিত ঠুরগা পাম্পড পাওয়ার প্রজেক্টের ওপর স্থগিতাদেশ – তাও সম্ভব হয়েছে আন্দোলনের ফলেই। এছাড়াও, জলাশয় বুজিয়ে রেললাইন নিয়ে যাবার সরকারি জেদের বিরুদ্ধে হুগলির ভাবাদীঘি রক্ষার লড়াইতেও পাওয়া গেছে প্রাথমিক সাফল্য।
এসবই মানুষকে সাহস জোগাচ্ছে, ক্ষমতা ও প্রশাসনের শক্তির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারছেন সাধারণ মানুষ। গ্রেটা থুনবার্গ আর এই বিশ্বজোড়া পরিবেশ আন্দোলনের একমাত্র মুখ নন, হাজার হাজার কচিকাঁচা এই আন্দোলনে এগিয়ে এসেছেন। ভারতের ঋদ্ধিমা পাণ্ডে, আদিত্য মুখার্জি, কেনিয়ার কালুকি পল মুতুকু, ইকুয়েডোরের নিনা গুয়ালিঙ্গা, উগান্ডার লিয়া নামুগের্বা প্রমুখ আন্তর্জাতিক স্তরেও পরিচিত।
এরা জানে, এদের আওয়াজ উদ্বৃত্ত পুঁজির অর্থনীতি ও মানবসর্বস্বতার বিরুদ্ধে, অত্যাচারী সরকার ও কর্পোরেটদের মিলিত শোষণের বিরুদ্ধে। এদের গলার শ্লোগানে আমাজন থেকে আরের জঙ্গল, কঙ্গো থেকে নিয়মগিরি এক হয়ে যায়। এরা জানে যে, প্রতি সপ্তাহে গড়ে কমপক্ষে তিনজন খুন হয়ে যায় পরিবেশ নিয়ে আওয়াজ তোলার জন্য - তবুও এরা আওয়াজ তোলে।
প্রত্যেক পরিবেশ-সচেতন মানুষই যেন নিজের মধ্যে আবিষ্কার করেছেন গ্রেটাকে, গ্রেটার অদম্য প্রাণশক্তিকে। আর তাই শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইতে পিছপা হচ্ছেন না তাঁরা। পৃথিবীর স্বার্থে, সুস্থ ভবিষ্যতের স্বার্থে এই ছোট-ছোট আন্দোলনগুলিই একদিন জন্ম দেবে বৃহৎ সাফল্যের। আগামীকালের ধর্মঘট সেই সুন্দর পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি সিঁড়ি। আপনিও অংশ নেবেন না কি, মনে-মনে হলেও?