১৯৫০ সাল। ভারতীয় গণনাট্য সংঘে তখন তুমুল বিতর্ক। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের নীতিগত ও সাংগঠনিক গোলযোগকে সরিয়ে খোঁজা হচ্ছে নতুন পথের ঠিকানা। চাই নতুন ধরনের নাটক। সেই সময়ে ৪৬ নং ধর্মতলা স্ট্রিটে এলেন এক যুবক। প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা। রোগা চেহারাটায় সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায় ক্ষুরধার চোখের দীপ্তি। পরিচিতরা তাঁকে ডাকেন ‘ভবা’ বলে। সঙ্গে একটি নাটকের পাণ্ডুলিপি। কালী ব্যানার্জি সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব দিলেন সেই নাটক অভিনয়ের। রিহার্সালের জন্য ঘরের বন্দোবস্ত করে দিলেন অনুপকুমার। গণনাট্য সংঘের মতবিরোধের দিনগুলিতে নাট্যপ্রযোজনায় নতুন পথের খোঁজ নিয়ে এল ঋত্বিক ঘটকের (Ritwik Ghatak) নাটক ‘জ্বালা’।
সমগ্র চারের দশক জুড়ে মৃত্যুমিছিলের সাক্ষী থেকেছে কলকাতা। স্বাধীনতার পরেও কি সুরাহা হয়েছিল সমস্ত সমস্যার? হয়নি বলেই বহু মানুষ বেছে নিয়েছিলেন আত্মহত্যার পথ। এরকম একত্রিশটা ঘটনা নিয়ে ঋত্বিক লিখেছিলেন ‘সুইসাইড ওয়েভ ইন ক্যালকাটা’। তার থেকে ছটি চরিত্র নিয়ে তৈরি হল ‘জ্বালা’। ঋত্বিকের ভাষায় ‘জ্বালা ইজ এ ডকুমেন্টারি’। অনেকে অবশ্য আপত্তি তুলেছিলেন নাটক অভিনয় নিয়ে। শুধুই মৃত মানুষের যন্ত্রণা, আশাবাদের চিহ্ন কোথায়? কিন্তু জ্বালা তো শুধু মৃত্যুর কথা বলে না। বলে এক সুন্দর দেশের কথা। যেখানে সব শান্তি, সব তৃপ্তি। কোথাও একটা আছে সেই দেশ। পথ খোঁজার শেষ হয়নি। খুঁজে পেতেই হবে সেই দেশটাকে। মানুষের উপরের খোলসটাকে বাদ দিলে যে অবিরাম আর্তনাদের মধ্যে সে চুপ করে বসে থাকে, ঋত্বিকের নাটক তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ায় তাকে। কিংবা হয়তো ভবিষ্যতদ্রষ্টার মতো খুঁজতে থাকে নিজেকেই।
‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো’ সিনেমার শেষে নীলকণ্ঠ বাগচী বলেছিল, “সব পুড়ছে। ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে, আমি পুড়ছি।” কোথাও গিয়ে যেন মিলে যায় দুটি গল্প। নীলকণ্ঠের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ঋত্বিক স্বয়ং। ‘বাগচী’ ছিলো ঋত্বিকের বংশের আদি পদবি, ‘ঘটক’ উপাধি। আবার শিল্পীজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা আগুনকে পান করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নীলকণ্ঠ। আকণ্ঠ মদ্যপান করে পুলিশের গুলিতে নীলকণ্ঠের তখন মৃতপ্রায়। দুগ্গাকে বলা এই অন্তিম সংলাপগুলিতে ঋত্বিক যেন এক নিঃশ্বাসে বলে যান নিজের জীবনের ক্লেদাক্ত বৃত্তান্ত। নীলকণ্ঠের পেটে বুলেটের ক্ষতের থেকেও বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে ব্যর্থতা ও হতাশার গণ্ডি থেকে বেড়িয়ে আসার পণ্ডশ্রমের ক্লান্তি।
অথচ জীবন এরকম ছিল না। অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে কলকাতায় এসে উঠেছিলেন ভবা নামের যুবকটি। ‘দলিল’, ‘অফিসার’-এর মতো নাটক পৌঁছে গেল সাধারণ মানুষের কাছে। কিন্তু মুক্তির অপেক্ষায় পড়ে থাকল ‘নাগরিক’ সিনেমাটি। তাতে কী? দুঃখবাদকে ঘৃণা করেন ঋত্বিক। কান্নাকাটি করতেন বলে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিজন ভট্টাচার্যকে। তাঁর বিশ্বাস ছিল সংগ্রামে, বেঁচে থাকায়। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত দিতে দিতেও যেখানে একটু জায়গা পেয়েছে, সেখানেই প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেকে। ‘কিছু একটা করতে হবে’—এই তাড়নায় জর্জরিত হয়ে রক্তের মধ্যে দুলে উঠেছিল স্পর্ধার মাতলামি।
আরও পড়ুন
'জীবনানন্দ, ঋত্বিক ও মানিককে নিয়ে হতে পারত জী-মা-ঋ ক্লাবও'
১৯৫৪ সালে গণনাট্য সংঘ থেকে বহিষ্কার করা হয় ঋত্বিক ঘটককে। সেই সময়েই জীবনে এলেন ‘Das kapital’ সুরমা ভট্টাচার্য। ১৯৫৫ সালে বিহারে ডকুমেন্টারির চিত্রগ্রহণের পর একটি চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন,
আরও পড়ুন
‘মদ্যপান ঘৃণা করত ঋত্বিক, মদ ধরেছে ইতর লোকগুলোকে গালাগাল করার জন্য’
“...দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে- মানুষকে বুঁদ করে দিতে পারব।... আমি তো জানি, বিরাট ঐশ্বর্য ভাণ্ডার আমার সামনে খোলা রয়েছে, তাঁর বিন্দুমাত্র আমি ধরতে পারলাম। ইচ্ছে আছে আবার আসব, আরও বড়ো, আরও বাস্তবপূর্ণ, আরও ব্যাপক ছবি করব।”
শুধু কাজ সম্পর্কে নয়, জীবন নিয়েও একই রকম আশাবাদী তিনি। কিন্তু তারপর? ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে ফ্লপ’। ‘কত অজানারে’ পরিত্যক্ত। ‘জ্বালা’-র চরিত্ররা খোঁজ করেছিল একটি নতুন দেশের। অন্তত এই বিশ্বাসটুকু নিয়ে মৃত্যুর পরের জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে তাঁরা। ঋত্বিকের কাছে তো নিজের দেশও নেই। একরাতের বেতার ঘোষণা চিরদিনের জন্য উদ্বাস্তু করে দিয়েছে তাঁকে। গণনাট্য ছাড়ার আগেই সেখানে প্রযোজনা করেছিলেন ‘দলিল’ নাটক। উদ্দেশ্য ছিল ‘ভাঙা বাংলার প্রতিরোধ’। নাটকে-সিনেমায় বারবার সন্ধান করেছিলেন ‘বাংলাদেশের মা’-এর। দেশভাগের যন্ত্রণা আজীবন ভুলতে পারেননি, চাননি বাঙালি সেই স্মৃতি ভুলে যাক। সুরমা ঘটক লিখছেন, “কতকগুলো ঘরছাড়া সম্পূর্ণ মানুষ যে নাটকীয় ঘোরাফেরা করছে তারই নাম ‘দলিল’।”
সেই দলে অর্জুন মালাকারদের সঙ্গে পাওয়া যাবে ঋত্বিককেও। দলিলের সন্ধানে অর্জুন খুঁজে বেড়াত দেশের রাজাকে। গুলি খেয়ে মরতে হয়েছিল তাঁকে, নীলকণ্ঠের মতোই। এ নাটক শেষ করতে পারেননি ঋত্বিক। তখনও আসেনি সেই পরিণতি। কিন্তু বিশ্বাস করতেন, আসবে একদিন। এই নাটকের শেষ পাতাটা লিখবে জনতা। তাদের জন্য ছেড়ে গেলেন শেষ পাতাটা। সেই মৃত্যুঞ্জয়ী আশা থেকে লিখেছিলেন, “বাংলারে কাটিছ কিন্তু দিলেরে কাটিবারে পার নাই।” আর সে বছরই সুরমাকে চিঠিতে তিনি লিখছেন, “-ও মেয়েকে আমি বহ্নিশিখার মত জ্বলে উঠতে দেখেছি। কিন্তু এই ছবিটিই আমার মনে থাকবে চিরটাকাল। আমার বাংলাদেশের মত শ্যামল বাংলার মেয়ে।”
সমাপতন? নাকি এটাই দেখতে চেয়েছিলেন তিনি? এর সঙ্গে মিলিয়ে নিতে কষ্ট হয় পরবর্তী ঋত্বিককে। তার কারণের মধ্যে লুকিয়ে অসংখ্য পরত, অসংখ্য চরিত্র। ‘দলিল’-এ অর্জুন শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিল রাজা আর শত্রু আসলে একই লোক। চিৎকার করে সে বলত, “দুশমন কনে?—তারে ধরতে আমি পারবই, তারে চিনতে আমি পারবই।” ঋত্বিক কি চিনতে পেরেছিলেন ভিতরে-বাইরের শত্রুদের? পারেননি বলেই হয়তো এক অনন্য মাতৃমূর্তির নিরন্তর সন্ধানে ব্যস্ত তাঁর চোখের সামনে শুধু পড়ে থাকে সাদা বোতলের অস্পষ্ট অবয়ব। সেই ঝাপসা কাঁচের এপাশ থেকে তিনি দেখতে থাকেন এই জ্বলন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধ্বংসনৃত্য। সেই অশুভ বাতাবরণের মধ্যে এক সৎ, হৃদয়বান শিল্পী হাত ছোঁড়ে নিস্ফল আক্রোশে। তারপর ক্লান্ত হয়ে একসময় জীবনটাকে তরল করে আত্মসমর্পণ করে আগুনের কাছে।
Powered by Froala Editor