Cannes-এর দরজা ঠেলে: ফরাসি সিনেমা, শিল্পীর আত্মানুসন্ধান ও অস্তিত্ব-সংকট

‘সুখের মধ্যে একটা বোকা বোকা ব্যাপার আছে, কিছু করার নেই...’

আচার্য জয়ন্ত বোসের এই কথাটাই বিগত দশ মিনিট ধরে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, আর আমি এক্কেবারে ফাঁকা ‘সালে দেবুসি’ প্রেক্ষাগৃহে চুপ করে বসে আছি। পরিচিত আর অপরিচিত একরাশ ভাবনা মিলেমিশে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত, অচেনা ঠেকছে নিজেকে। হল আধো-আলো আধো-অন্ধকারে ঢাকা। চোখের সামনের বিরাট পর্দাটার আলো নিভেছে বেশ খানিকক্ষণ হল। হঠাৎই হলের দায়িত্বে থাকা ভদ্রমহিলার তাগাদায় সম্বিত ফেরে; বলেন, 'মঁন্সিয়ে দয়া করে বেরিয়ে আসুন, পরের ছবির জন্য দর্শকরা বাইরে অপেক্ষা করছেন।' ওঁর কথার উত্তর না দিয়েই আমি কোনোরকমে উঠে হল থেকে বেরিয়ে আসি।

আমার এই অবস্থার কারণ কী? বরং লিখেই প্রকাশ করা যাক সে-অন্তর্ঘাতের কথা।

দুটো সিনেমা, দুটোই ফরাসি ভাষার। একটার নাম 'লে আমান্দিয়ে (ফরেভার ইয়াং)' (Les Amandiers), পরিচালক ভ্যালেরিয়া বব্রুনি তেদেসচি, অন্য সিনেমাটার নাম 'ডন জুয়ান' (Don Juan), পরিচালক সের্জে বোজোঁ। প্রথম ছবিটা এবার ‘ইন কম্পিটিশান ফিচার ফিল্ম’ (In Competition Feature Film) বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। 'ডন জুয়ান' প্রতিযোগিতার বাইরের সিনেমা, স্পেশাল স্ক্রিনিং। বাইরে থেকে দেখতে গেলে, গল্প, ফর্ম, জঁর, শব্দের ব্যবহার এমনই নানান দিক থেকে সিনেমাদুটো আপাদমস্তক সম্পূর্ণ আলাদা। প্রথম ছবিটা আমাদের চিরপরিচিত গল্প বলার ধরনে তৈরি, যেখানে একঝাঁক তরুণ-তরুণী তাদের মেধা, বন্ধুত্ব, প্রেম, মন ভাঙা-গড়ার, এবং জীবনের প্রথম ক্রাইসিসের হাত ধরে এক নামকরা থিয়েটার স্কুলে ধীরে ধীরে অভিনেতা হয়ে উঠছে। অন্যদিকে ডন জুয়ান নিজেই একটা সিনেমার চরিত্র, আর সেই চরিত্রে যে মানুষটি (ছবির নায়ক) অভিনয় করছেন, এ-ছবি তাঁর গল্প। গল্প বলার ধরনেও ডন জুয়ান আলাদা, এক্সপেরিমেন্টাল, ছবিতে গানের অদ্ভুত ব্যবহার দর্শককে অবাক করে। 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: বিধ্বস্ত ইউক্রেন, প্রতিবাদী ক্যামেরা ও এক আতঙ্কিত মায়ের গল্প

'ডন জুয়ান' চলচ্চিত্রের পোস্টার

 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: ছবিতে-গল্পে ‘অদেখা’ চলচ্চিত্র উৎসব

কিন্তু তা সত্ত্বেও কোথাও গিয়ে যেন দুই সিনেমা অভিন্ন হয়ে যায়। সিনেমাদুটো জুড়ে, তার চিত্রনির্মাণের ছত্রে ছত্রে আমরা কেবলই এক শিল্পীর মানবসত্তা আর সৃজনসত্তার টানাপোড়েনের সাক্ষী হয়ে থাকি। আর সেই টানাপোড়েন থেকেই জন্ম নেয় শিল্পীর সংকট, আর সেখান থেকেই অমোঘ শিল্প। ‘লে আমান্দিয়ে’ সিনেমার একটা দৃশ্য এদিক থেকে বেশ উল্লেযোগ্য। আমেরিকার এক নামী ফিল্ম অ্যাকাডেমিতে কদিনের ওয়ার্কশপে এসে ছাত্ররা শিখতে শুরু করে, কীভাবে ভয়-লজ্জা সরিয়ে রেখে খোলস ছাড়িয়ে নিজের অন্তর-সত্তাকে বের করে আনতে হবে। সমস্ত সহপাঠীদের সামনে নিজের গভীর থেকে গভীরতম সত্যি তুলে ধরার আগে তাদের বলতে হয় ‘আমি অ্যাম এওয়ার...’, অর্থাৎ অন্যদের কাছে নিজের নগ্নতা প্রকাশিত হওয়ার আগে নিজের কাছে নিজেকেই উলঙ্গ হতে হয়। এই আত্ম-অবগতির নামই তো শিল্প! 

আরও পড়ুন
Cannes-এর দরজা ঠেলে: সত্যজিৎ-জাদুতে আবারও মুগ্ধ আন্তর্জাতিক দর্শক

'ডন জুয়ান' চলচ্চিত্রের দৃশ্য

 

অন্যদিকে ডন জুয়ান একজন ক্যাসানোভা। নারী-আসক্তি তার মজ্জাগত। সেই চরিত্রে অভিনয় করবেন আমাদের নায়ক, যার প্রাক্তন প্রেম নায়িকা হয়ে সেই নাটকেই ফিরে আসে। নায়ক যখন তাঁর নিজের জীবনেও রাস্তাঘাটে নানা মহিলাদের সঙ্গে অভব্য আচরণে লিপ্ত হয়ে, পরমুহূর্তেই আবার সেই স্মৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। আর আমরা, এক অভিনেতার ধীরে ধীরে মানুষ থেকে চরিত্র হয়ে ওঠার মুগ্ধ সাক্ষী হয়ে উঠি। বুঝতে পারি, একাধিক নারীর মুখ ও শরীরে নিজের একমাত্র প্রেমকে খুঁজতে খুঁজতেই, দুটো ভিন্ন মানুষ ও চরিত্র ‘ডন জুয়ান’ হয়ে ওঠেন। দুটি সিনেমাই তাই হাজারো ব্যক্তিগত অন্তর্ঘাত ও সংকটের ঘূর্ণনে দুই চরিত্রের নিষ্কলুষ শিল্পী হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়েই শেষ হয়। ডন বলেন, ‘আই অ্যাম অ্যান অ্যাক্টর...' 

'লে আমান্দিয়ে' চলচ্চিত্রের দৃশ্য

 

এই বিষয়েই আলোচনা হচ্ছিল বিশিষ্ট সংস্কৃতি-আলোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ’৭০-এর দশকে সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি-পদ্ধতির প্রসঙ্গে কথায়-কথায় সঞ্জয়দা বললেন, "৭৫তম কান চলচিত্র উৎসবে এই যে আবারও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ দেখানো হল, এই ঘটনা বিশেষ ভাবে গুরুত্ববহ। কারণ এ-ছবিতে সত্যজিৎ বারবার নিজের সমাজ মনস্কতার সঙ্গে সমসাময়িক যুবসমাজের রাজনৈতিক ঘৃতাহুতির সংঘাতকেই দেখাতে চেয়েছেন। এমনকি নিজের তৈরি ফিল্ম সোসাইটির বিষয়েও এ-সংকট বার বার তাঁর কাজে ফিরে এসেছে। এটাই তো শিল্পীর সংকট, এখান থেকেই তো শিল্পের জন্ম।" তাছাড়া ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ সিনেমাটি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘শিল্পী’ গল্পের উল্লেখ দিয়ে শেষ হওয়া, কিম্বা পিকাসোর নিজের শিল্পীসত্তার নিদর্শনে বলে ওঠা সেই অমোঘ বাক্য, 'বেশ্যারও উলঙ্গ হতে সাহস লাগে'— এসব আসলে আয়নার সামনে শিল্পীর নিজেকে কাটাছেঁড়া করে দেখারই পদ্ধতি বলে মনে করেন সঞ্জয়দা। তাঁর নিজের কথায়, ‘সত্যজিতের কলকাতা-ত্রয়ী এবং ঋত্বিকের যুক্তি-তক্কো-গপ্পো এই কয়েকটি সিনেমাই, সত্তর দশকের সেই ঘূর্ণিবাতাসে, আধুনিক ভারতীয় সংস্কৃতিতে শিল্পীর নিজস্ব সংকটের গল্প বলে।’ 

এই দুই ফরাসি ছবির অভিজ্ঞতাও আমাকে সেই নিঃস্বতা ও সংকটের উঠোনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল৷ মনে পড়ে গেল, ২০০৯ সালে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে কিম-কি-ডুকের ৩-৪টে ছবি পরপর দেখে ঠিক এমনই একটা উপলব্ধির সম্মুখীন হয়েছিলাম। বেশ খানিক্ষণ আকাডেমির সামনের ফুটপাথে চুপ করে বসেছিলাম সকলে। মনের ভিতর যত্ন সহকারে সাজিয়ে তোলা বাঁচার নিয়মগুলো একটানে ছিঁড়ে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন পরিচালক। আয়নার প্রতিবিম্ব আমাদের দেখে বিদ্রূপ করেছিল সেদিন। ব্যক্তির স্বতন্ত্র সংকটকে বাদ দিয়ে কোনো শিল্পই আধুনিক হয়ে উঠতে পারে না। প্রত্যেকটা নতুন সৃষ্টিতে নিজেকে একেবারে ভেঙেচুরে তছনছ করে একেবারে নতুন আমিতে রূপান্তরিত করেন যে শিল্পীরা, তাঁদের কাজ মানুষের মনে থেকে যাবেই। সময় আসলে সমুদ্রের মতো, যা নেয়, তা আবার মাঝেমধ্যে ফিরিয়েও দিয়ে যায়। ১০ বছর আগের সেই  শ্বাশত উপলব্ধি আমায় আবারও ফিরিয়ে দিল ৭৫ বছরে পা দেওয়া কান চলচিত্র উৎসব। আর কীই-বা চাওয়ার থাকতে পারে!

Powered by Froala Editor

More From Author See More