সময়টা ১৯৭৫ সাল। পৃথিবীর বাতাস তখনও কার্বনে ছেয়ে যায়নি। তখনও বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যেত। কিন্তু দূষণের শুরুটা হয়ে গিয়েছে ততদিনে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ততদিনে প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপদটা যেন একটু আগে থেকেই টের পেয়েছিলেন সুকুরো মানাবে। জাপানের এই আবহাওয়াবিদ তাই লিখে ফেললেন একটি দীর্ঘ গবেষণাপত্র। যার শেষে তিনি দেখালেন, বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেলে জলবায়ুর উপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। অবশ্য এর আগেই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন তিনি। নানারকম বায়ুস্রোতের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে তৈরি করেছেন একটি সম্পূর্ণ নতুন মডেলও। তারপর ৪৬ বছর পেরিয়ে এসে আজ নোবেল পুরস্কারে (Nobel Prize) সম্মানিত হলেন মানাবে।
সুকুরো মানাবের সঙ্গেই যৌথভাবে এবছর নোবেল পেলেন ইতালির দুই বিজ্ঞানী ক্লাউস হেসেলম্যান এবং জিওরজিও পারিসি। হেসেলম্যানের গবেষণার শুরুও সত্তরের দশকের শুরুতেই। তখনও পর্যন্ত আবহাওয়াবিজ্ঞানকে কেবলমাত্র পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক বলেই মনে করা হত। হেসেলম্যান তার সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এবং ফেইনম্যান মডেলকে। এভাবেই সমুদ্রস্রোতের তির্যক গতিপথগুলির মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করলেন তিনি। আপাতভাবে মনে হতে পারে এই গবেষণা নিছক তাত্ত্বিক স্তরের। কিন্তু এর সঙ্গেই যদি মানাবের গবেষণাকে মিলিয়ে দেখা যায়, তাহলেই ধরা পড়ে তাৎপর্য। আসলে দুজনে পৃথিবীর দুই প্রান্তে বসে আমাদের সচেতন করে যাচ্ছিলেন আগামী দুর্যোগ সম্পর্কে। মানুষের অধিক মুনাফালাভের ইচ্ছা কীভাবে ক্রমশ ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে পৃথিবীকে।
মানাবে বা হেসেলম্যানের থেকে পারিসির গবেষণার বিষয় অনেকটাই আলাদা। তাঁর কাজ পদার্থের কোয়ান্টাম স্তরের চরিত্র বোঝা। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাটি তিনি করেছেন তরল কাঁচের উপর। কাঁচকে তরল অবস্থায় দেখতে আমরা অভ্যস্থ নই কেউই। কারণ এই দশা স্থায়ী নয়। অথচ একটি অস্থায়ী অবস্থার মধ্যেই অনেকগুলি স্থায়ী অবস্থার অস্তিত্ব থাকতে পারে। তরল কাঁচের মধ্যেও এমন অনেকগুলি স্থায়ী, বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে অধিস্থায়ী অবস্থার সন্ধান পাওয়া যায়। কেমন তাদের গঠন? কেনই বা তারা বাস্তবে স্থায়ীত্ব পেতে পারে না? ১৯৯৯ সাল থেকেই এই নিয়ে গবেষণা করে আসছেন পারিসি। ২০২০ সালে একেবারে স্নাতক স্তরের পড়ুয়াদের উপযোগী করেও লিখে ফেলেছেন একটি বই।
খালি চোখে তিন বিজ্ঞানীর তিনটি পৃথক ধারার গবেষণাকে এক জায়গায় নিয়ে এল নোবেল ইনস্টিটিউট। এঁরা কেউই একসঙ্গে কোনো গবেষণা করেননি। অথচ প্রতিটি গবেষণাই যেন একটা সুতোয় বাঁধা। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমরা। ২০২১ সাল সম্ভবত ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের বছর। এই বছরই সবচেয়ে বেশি বন্যা, সবচেয়ে বেশি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে দেশজুড়ে। আবার এই পরিস্থিতিও তো আবহাওয়ামণ্ডলের অস্থায়ীত্বকেই বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমরা তারই মধ্যেকার একাধিক অধিস্থায়ী অবস্থার মধ্যে রয়েছি। আপেক্ষিকভাবে যে পরিবর্তনকে বুঝতে গেলে কেবল পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের উপরেই নির্ভর করতে হয়। কিন্তু নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের গবেষণা এই সমস্ত বিষয়কে গেঁথে দেয় একটি সাধারণ সূত্রের নিয়মে। যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের সামগ্রিক ধারাটাকেই বোঝা সহজ হয়। এবার সেই গবেষণাকেই কাজে লাগানোর সময় এসে গিয়েছে।
Powered by Froala Editor